পালসারের বিমে স্থানকালের ঢেউ
আজ থেকে প্রায় ১৩০ কোটি বছর আগে এক জোড়া সাধারণ ব্ল্যাকহোল একসাথে মিলে আরো বড় একটা ব্ল্যাকহোল বানানোর সময় স্পেসে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি করেছিল তা ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন ‘লাইগো‘ নামের এক অদ্ভুত অব্জার্ভেটরিতে। সেই প্রথম মানুষের হাতে ধরা পড়ে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর শুধু জ্যোতির বিজ্ঞান থাকে না, এস্ট্রোনমারের মানমন্দিরে আলোর তরঙ্গের সাথে যোগ দেয় স্থানকালের তরঙ্গ। আলোর তরঙ্গ যদি হয় ‘তড়িতরঙ্গ‘ তবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে বলা যায় ‘মহাতরঙ্গ‘। কোপার্নিকাস সূর্যকে কেন্দ্রে বসানোর প্রায় একশ বছর পরে গ্যালিলিও তার দুরবিন আকাশের দিকে তাক করে সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন। আর আইনস্টাইন স্থানকালকে মহাকর্ষ তত্ত্বের কেন্দ্রে বসানোর প্রায় একশ বছর পরে স্পেসটাইমে গ্র্যাভিটির ঢেউ পাওয়া গিয়েছিল আট বছর আগে একদিন।
লাইগো’র আবিষ্কার গ্যালিলিওর কাজের মতোই বৈপ্লবিক ছিল। পার্থক্য শুধু এই যে বর্তমান যুগে বড় বড় বৈজ্ঞানিক বীক্ষণ গ্যালিলিওর মতো একা এক জনের পক্ষে করা সম্ভব না, প্রয়োজন অনেক সায়েন্টিস্ট-ইঞ্জিনিয়ার-পলিটিশান-বুরোক্র্যাটের সম্মিলিত প্রচেষ্টা—চেষ্টা না, প্রচেষ্টা। গ্যালিলিওর আগে মহাবিশ্ব চেনার একমাত্র উপায় ছিল মানুষের চোখ, গ্যালিলিওর পরে চোখের তুলনায় সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর টেলিস্কোপ বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তবে সেই যজ্ঞে সহায় ছিল কেবল দৃশ্যমান আলো। উনিশ শতকের শেষ দিকে দৃশ্য আলোর বাইরে অনেক অদৃশ্য আলো পাওয়া যায় এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধেই আকাশ থেকে আসা অদৃশ্য আলো ধরার কাজ শুরু হয়ে যায়। তবুও তরঙ্গ বলতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ঝুলিতে আলো ছাড়া কিছু ছিল না। গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অব্জার্ভেটরি আলোর বাইরে আরো এক তরঙ্গকে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে, তড়িতরঙ্গের সাথে যুক্ত করেছে মহাতরঙ্গ। তাই লাইগো গ্যালিলিওর দুরবিনের সমান বৈপ্লবিক।
গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ কমিউনিটি গত এক দশক ধরে একের পর এক আবিষ্কারে উত্তাল। লাইগো’র তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ছিল কয়েক শ হার্জ, অর্থাৎ তা এক সেকেন্ডে কয়েক শ বার উঠানামা করে, কয়েক শ বার কাঁপে। এই মাসে ইন্টারন্যাশনাল পালসার টাইমিং অ্যারে (আইপিটিএ) সংঘের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা ন্যানোহার্জ কম্পাঙ্কের মহাতরঙ্গ আবিষ্কারের খবর পাবলিশ করেছেন। কম্পাঙ্ক ন্যানোহার্জ হওয়ার অর্থ তরঙ্গটা এক বিলিয়ন সেকেন্ডে, মানে তিন দশকে, মাত্র এক বার কাঁপে। এই তরঙ্গের পরশ পেতেও তাই অনেক সময় লাগে। উত্তর আমেরিকার পিটিএ’র নাম ন্যানোগ্র্যাভ এবং এই টিমের সদস্যরা তাদের আবিষ্কারের দাবি পাবলিশ করেছেন পনের বছর ধরে তিনটা রেডিও দুরবিন দিয়ে ৬৭টি পালসার পর্যবেক্ষণ করার পরে। একই সাথে আইপিটিএ’র অংশ হিসাবে ইউরোপ, ইন্ডিয়া, চায়না ও অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব পিটিএ’র রেজাল্টও প্রকাশিত হয়েছে।
লাইগোর সেই শতহার্জের তরঙ্গ ১৩০ কোটি বছর আগে তৈরি হয়েছিল মাত্র এক জোড়া সাধারণ ব্ল্যাকহোলের মিলনে, আর পিটিএ’র পাওয়া ন্যানোহার্জ তরঙ্গের সূচনা হয়ত ১৩০০ কোটি বছর আগে কয়েক লক্ষ জোড়া সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের মিলনে। কয়েক লাখ মিলনের ফলে যে-কয়েক লাখ তরঙ্গ তৈরি হয়েছিল ১২–১৩ বিলিয়ন বছর আগে তাদের সম্মিলিত সিম্ফনি পৃথিবীর মাটিতে লাইগোর মতো মহাতরঙ্গমাপক বসিয়ে মাপা সম্ভব না। প্রয়োজন গ্যালাক্টিক ডিটেক্টর যা এস্ট্রোনমাররা বানিয়েছেন পালসার থেকে আসা রেডিও বিকিরণের পালস ডিটেক্ট করতে পারে এমন সব রেডিও দুরবিন দিয়ে।
একটা পিটিএ অনেকগুলো পালসারের অ্যারে, সবগুলো পালসার এক বা একাধিক রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে অব্জার্ভ করা হয় এবং অনেক বছরের অব্জার্ভেশন যোগ করে তাতে মহাতরঙ্গের চিহ্ন খোঁজা হয়। কিভাবে বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে লাইগো কিভাবে কাজ করে।
লাইগো দেখতে তার প্রথম অক্ষর L-এর মতো। ‘এল’ আকৃতি তৈরি হয় পাইপলাইনের মতো দুইটা বিশাল বাহু দিয়ে। দুই বাহুই ৪ কিলোমিটার করে লম্বা এবং দুয়ের মধ্যে কোণ ঠিক নব্বই ডিগ্রি। দুই পাইপলাইন এসে এল-এর কোণায় যেখানে মিলিত হয় সেখানে অব্জার্ভেটরির কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে থাকে লেজার বিমের সোর্স, বিম বিভাজক ও বিম ডিটেক্টর। সোর্স থেকে একটা লেজার বিম বিভাজকে পাঠালে (উপরের ছবিতে 1) বিভাজক বিমটিকে সমান দুই ভাগে ভাগ করে দুই বাহু বরাবর পাঠিয়ে দেয় (2)। প্রতিটা বাহুর শেষে আছে একটা করে আয়না। আয়না থেকে দুই বিম প্রতিফলিত হয়ে পাইপলাইনের ভিতর দিয়ে ফিরে আসে ডিটেক্টরে (3)।
এই অডিসির সময় কোনো মহাতরঙ্গ না থাকলে দুই যমজ বিম একে অপরকে পুরাপুরি ধ্বংস করে দেয় এবং ডিটেক্টরে কোনো লাইট পাওয়া যায় না (5)। কিন্তু এ-সময় কোনো মহাতরঙ্গ এখান দিয়ে অতিক্রম করলে এক বাহু সংকুচিত হয় আর অন্য বাহু প্রসারিত হয় (4), ফলে একেক বাহুর প্রতিফলিত বিম একেক দূরত্ব অতিক্রম করে এবং দুই বিম দুই সময়ে ডিটেক্টরে পৌঁছায় (6)। সময়ের এই পার্থক্য থেকে জানা যায় মহাতরঙ্গ দুই বাহুকে কি পরিমাণ টেনেছে এবং এই টানের পরিমাণ থেকে পাওয়া যায় মহাতরঙ্গের মানচিত্র। মহাতরঙ্গ কেবল পাইপলইনের লোহালক্কর ধরে টান দিচ্ছে না বরং দুই বাহু যে স্থানের মধ্যে অবস্থিত স্বয়ং সেই স্থানকে উদ্বেল করে দিচ্ছে। পানিতরঙ্গ যেমন জলের তলকে উচ্ছলিত করে মহাতরঙ্গ তেমন স্থানের জালকে উদ্বেলিত করে।
পিটিএ একই কাজ করে, তবে অন্যভাবে। এক্ষেত্রে আমরা কোনো লেজার পাঠাই না বরং পালসার থেকে আসা রেডিও তরঙ্গ ডিটেক্ট করি। লেজার বিমের জায়গা দখল করে পালসারের বিম। পিটিএতে কোনো বিম বিভাজক বা আয়না নাই, আছে কেবল বিমের সোর্স ও ডিটেক্টর। সোর্স হলো পালসার, ডিটেক্টর হলো রেডিও দুরবিন। আমাদের গ্যালাক্সির অনেক তারা মৃত্যুর পরে ঘূর্ণায়মান নিউট্রন স্টারে পরিণত হয় এবং যেসব নিউট্রন স্টারের দুই মেরু থেকে দুইটা আলোর বিম বের হয় তাদের নামই পালসার। পিটিএ যেসব পালসার নিয়ে কাজ করে তারা এক সেকেন্ডে প্রায় এক হাজার বার ঘোরে। ঘোরার সময় একটা বিম যখন আমাদের দৃষ্টিরেখা বরাবর আসে তখন পালসার দেখা যায়, অন্য সময় দেখা যায় না। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে আমরা এই সব পালসার থেকে এক হাজার করে পালস পাই। গড়ে এক মিলিসেকেন্ডে একটা করে পালস পাই বলে এদের নাম মিলিসেকেন্ড পালসার (MSP)।
উপরের গিফ এনিমেশনে দেখা যাচ্ছে নিউট্রন স্টারের বিম দুইটা, কিন্তু শুধু একটা বিমই নির্দিষ্ট সময় পর পর আমাদের দিকে আসে, শুধু এটাই আমরা রেডিওতে ধরতে পারি। পৃথিবীতে বসানো রেডিও দুরবিন দিয়ে এই পালসারের উজ্জ্বলতা মাপতে থাকলে বিম যখন আমাদের দিকে আসবে ঠিক তখন উজ্জ্বলতা বেড়ে যাবে পালসের মতো যা ছবির নিচের প্যানেলে দেখানো হয়েছে; এখানে লাল বৃত্তটা সময়ের সাথে বিমটির অবস্থানের পরিবর্তন দেখাচ্ছে।
এখন ধরা যাক উপরের ছবির মতো পাঁচটা পালসার পৃথিবীর চারদিকে স্থানকালের জালে ছড়িয়ে আছে এবং মহাতরঙ্গের কারণে স্থানের উচ্ছলিত জাল এবড়ো-খেবড়ো। শুধু তিনটি পালসার থেকে পালস পৃথিবীতে আসছে এবং আমরা নির্দিষ্ট সময় পর পর একটা করে পালস রেডিও ডিটেক্টর দিয়ে মাপছি। স্থানকালের ঢেউয়ের কারণে পৃথিবী থেকে এই তিন পালসারের দূরত্ব পাল্টাচ্ছে, স্বাভাবিকের চেয়ে কোনোটা কাছে চলে এসেছে কোনোটা দূরে সরে গেছে। কাছের পালসার থেকে পালস আগে পৌঁছাচ্ছে, দূরেরটা থেকে পালস দেরিতে পৌঁছাচ্ছে।
পৃথিবী থেকে পালসার পর্যন্ত দূরত্বটা লাইগোর একটা বাহুর মতো যা মহাতরঙ্গের কারণে সংকুচিত বা প্রসারিত হয়। লেন্থের এই পরিবর্তন মাপার মাধ্যমেই আমরা মহাতরঙ্গের হদিশ পাই। আইপিটিএ’র সদস্যরা এই বছর ঠিক এই কাজটাই প্রথম বারের মতো করে দেখিয়েছেন। লাইগোর বাহু ছিল দুইটা, আর পিটিএতে প্রতিটা পালসারই পৃথিবীর সাথে মিলে একটা বাহু তৈরি করে। আইপিটিএ’র বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০টি মিলিসেকেন্ড পালসার অব্জার্ভ করেছেন, তার মানে আইপিটিএ’র মহাতরঙ্গমাপকে বাহুর সংখ্যা প্রায় একশ।
পিটিএ যে-তরঙ্গের পরশ পেয়েছে তার কম্পাঙ্ক ন্যানোহার্জ কেন? বুঝতে হলে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে একটু ভাবতে হবে। আলোর তড়িচ্চুম্বক বর্ণালির মতো মহাতরঙ্গেরও একটা স্পেক্ট্রাম আছে। এই স্পেক্ট্রামে ফ্রিকোয়েন্সি বা ওয়েভলেন্থের মাধ্যমে মহাতরঙ্গকে উপরের ছবির মতো বিভিন্ন ক্লাসে ভাগ করা যায়। আলোর ক্ষেত্রে যেমন এক্স-রে অনেক ছোট, দৃশ্যমান আলো মাঝারি আর রেডিও অনেক লম্বা, তেমনি মহাতরঙ্গও ছোট বড় মাঝারি হতে পারে। ওয়েভলেন্থ ছোট তরঙ্গের ক্ষেত্রে কম, বড়দের ক্ষেত্রে বেশি। কম্পাঙ্ক যেহেতু লেন্থের উল্টা সেহেতু ছোট তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বেশি, বড় তরঙ্গের কম। কম্পাঙ্কের সাথে পিরিয়ডের সম্পর্কও উল্টা, যার কম্পাঙ্ক বেশি তার পিরিয়ড কম কারণ সে কম সময়ে বেশিবার উঠানামা করে।
একেক ওয়েভলেন্থ, কম্পাঙ্ক বা পিরিয়ডের আলো ডিটেক্ট করতে যেমন একেক ধরনের টেলিস্কোপ লাগে, তেমনি একেক কম্পাঙ্কের মহাতরঙ্গ ডিটেক্ট করতে লাগে একেক ধরনের ডিটেক্টর। লাইগোর মতো পৃথিবীর মাটিতে বসানো ডিটেক্টর দিয়ে মিলিসেকেন্ড পিরিয়ডের অর্থাৎ কয়েক শ হার্জ কম্পাঙ্কের মহাতরঙ্গ ধরা যায় (উপরের ছবিতে একেবারে ডানে)। মহাকাশে ভাসমান ডিটেক্টর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড বা ঘণ্টা পিরিয়ডের মহাতরঙ্গ ভবিষ্যতে সনাক্ত করা সম্ভব হবে। আর কয়েক বছর পিরিয়ডের অর্থাৎ এক ন্যানোহার্জের মতো কম্পাঙ্কের মহাতরঙ্গ ডিটেক্ট করা যায় পালসার থেকে পালস কখন আসছে তা টাইমিং করার মাধ্যমে।
একেক ধরনের তরঙ্গের ডিটেক্টর যেমন আলাদা সোর্সও অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। লাইগোর মতো মাটিতে বসানো ইন্টারফেরোমিটার দিয়ে যেসব তরঙ্গ ডিটেক্ট করা হয় তাদের উৎস প্রধানত পরস্পরের চারদিকে ঘুরতে থাকা এক জোড়া ছোট মরাতারা (নিউট্রন-স্টার বা ব্ল্যাকহোল)। এসব মরাতারার ভর খুব বেশি হলে সূর্যের একশ গুণ হতে পারে। অন্যদিকে পিটিএ যেসব তরঙ্গ ডিটেক্ট করছে তাদের উৎস পরস্পরের চারদিকে ঘুরতে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল জোড়া যাদের একেকটার ভর সূর্যের চেয়ে কয়েক কোটি গুণ বা তারও অনেক বেশি হতে পারে। এসব ব্ল্যাকহোল থাকে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে, যে-গ্যালাক্সি যত ভারী তার কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোলও তত ভারী। বর্তমানে গ্যালাক্সিদের মধ্যে দূরত্ব এত বেশি যে এই ধরনের সুপারম্যাসিভ যুগল খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু ১২–১৩ বিলিয়ন বছর আগে যখন ইউনিভার্সের প্রায় সব গ্যালাক্সির জন্ম হয়েছিল তখন গ্যালাক্সিদের যুগলনাচ ও মহামিলন অনেক দেখতে পারার কথা। সেই সব যুগলনাচ ও মহামিলনের কারণে ইউনিভার্সের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য মহাতরঙ্গ। নির্দিষ্ট কোনো এক জোড়া গ্যালাক্সি একে অপরের চারদিকে সর্পিল পথে ঘুরতে ঘুরতে একসাথে মিলে যাওয়ার সময় স্থানকালে যে-মহাতরঙ্গ তৈরি করেছিল তা আমাদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না, কিন্তু অসংখ্য গ্যালাক্সি জুটির পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে ইউনিভার্সের সব ‘খানে’ যে মহাতরঙ্গের জন্ম হয়েছিল তা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ হিসাবে ডিটেক্ট করা সম্ভব, এবং ঠিক এই কাজটাই করছেন আইপিটিএ’র মেম্বাররা।
ন্যানোগ্র্যাভ নামে পরিচিত নর্থ আমেরিকার পিটিএ’র রেজাল্ট উপরে দেখানো হয়েছে এবং এটা বুঝতে পারলেই সব মহাদেশের পিটিএ’র কাজ বুঝা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি রেডিও দুরবিন (এরেসিবো, গ্রিন ব্যাংক, ভিএলএ) দিয়ে ন্যানোগ্র্যাভ টিমের সদস্যরা পনের বছর ধরে ৬৭টি পালসার অব্জার্ভ করেছেন, প্রতিটা পালসার থেকে আসা পালসের আগমনকাল (টাইম অফ এরাইভাল, TOA) মেপেছেন। সাতষট্টি পালসার থেকে জুটি তৈরি করা যায় মোট ২২১১টি। উপরের গ্রাফের এক্স-অক্ষে (কোটি) আছে প্রতি জোড়া পালসারের মধ্যে কৌণিক দূরত্ব, মিনিমাম ০ ডিগ্রি থেকে ম্যাক্সিমাম ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত; মনে রাখতে হবে, এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত কোণ মোট ১৮০ ডিগ্রি। এই গ্রাফে ডেটা পয়েন্ট মাত্র ১৫টা থাকার মানে এই না যে মাত্র পনের জোড়া পালসার দেখানো হচ্ছে; এখানে সবগুলো কৌণিক দূরত্বকে মোট ১৫টা বিনে গড় করা হয়েছে নয়েজের তুলনায় সিগনালকে শক্তিশালী করার জন্য।
গ্রাফের ওয়াই-অক্ষে (ভুজ) আছে বিভিন্ন কৌণিক দূরত্বের পালসারের মধ্যে কোরিলেশন, যা বুঝতে হলে আরেকটু খাটতে হবে। আগেই বলেছি, মহাতরঙ্গের কারণে পালসারের পালস স্বাভাবিক সময়ের আগে বা পরে আসে। মহাতরঙ্গ না থাকলে বিভিন্ন কৌণিক দূরত্বের পালসার থেকে আসা পালসের আগমনকালের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট সম্পর্ক বা কোরিলেশন থাকত না। গ্রাফে সবুজ সরলরেখা দিয়ে এই অবস্থাটি দেখানো হয়েছে; গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (GWB) না থাকলে সব কৌণিক দূরত্বে কোরিলেশন হতো শূন্য। কিন্তু মহাতরঙ্গের পটভূমি থাকলে কোণের সাপেক্ষে কোরিলেশন একটা নির্দিষ্ট কার্ভ অনুসরণ করবে যা বেগুনি রঙের ড্যাশ-রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে। আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্বের মাধ্যমে এই কার্ভ প্রেডিক্ট করা যায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ন্যানোগ্র্যাভের পনেরটা ডেটা পয়েন্ট তাত্ত্বিক কার্ভটিকে অনেকটাই অনুসরণ করে। গাণিতিক তত্ত্বের মাধ্যমে প্রেডিক্ট করা কার্ভের সাথে অব্জার্ভেশন থেকে পাওয়া ডেটা পয়েন্টের এই মিল দেখেই বিজ্ঞানীরা রেজাল্ট প্রকাশ করেছেন।
আইপিটিএ সংঘের অংশ হিসাবে বিভিন্ন মহাদেশের পিটিএ বিভিন্ন রেডিও দুরবিন ব্যবহার করে। এখানে নয়টা রেডিও টেলিস্কোপের ছবি দেয়া হয়েছে। ইউরোপিয়ান পিটিএ’র ব্যবহার করা দুরবিনের মধ্যে আছে যুক্তরাজ্যের জডরেল ব্যাংক অব্জার্ভেটরির লোভেল টেলিস্কোপ, জার্মানির এফেলসবার্গ ১০০-মিটার রেডিও টেলিস্কোপ এবং নেদারল্যান্ডের ভেস্টারবর্কে স্থাপিত সিন্থেসিস রেডিও টেলিস্কোপ। চাইনিজ পিটিএতে ইউজ করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেডিও এন্টেনা ফাস্ট। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন জায়ান্ট মিটারওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপ। অস্ট্রেলিয়াতে ইউজ করা হয় পার্কস অব্জার্ভেটরি। ন্যানোগ্র্যাভের তিন দুরবিনের কথা আগেই বলেছি।
পালসারের মেরু থেকে রেডিও কম্পাঙ্কের বিকিরণ কেন বের হয় তা আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না, যদিও কেমব্রিজে জসলিন বেল বার্নেলের হাত ধরে প্রথম রেডিও পালসার আবিষ্কারের পর পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। মহাতরঙ্গের পরশ পাওয়ার জন্য রেডিও দুরবিন দিয়ে মিলিসেকেন্ড পালসার থেকে আসা পালসের আগমনকাল (টিওএ) মাপতে হয়। এসব পালসারের পিরিয়ড যেহেতু খুব ছোট সেহেতু এক সেকেন্ড পিরিয়ডের পালসার দিয়ে মাপার প্রসেসটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। নিচে লোভেল টেলিস্কোপ দিয়ে শোনা একটা পালসারের পালস-ট্রেন ও অডিও দেয়া আছে। দুরবিনের রিসিভার থেকে যা পাওয়া যায় তা একটা স্পিকারের সাথে যুক্ত করে দিলেই শব্দ শোনা সম্ভব। এই সাউন্ড শুনে পালসার আবিষ্কারের প্রথম যুগে কেউ কেউ এটাকে এলিয়েন সভ্যতার পাঠানো সংকেতও ভেবেছিলেন।
আসলে এই শব্দ রহস্যজনক কিছু না। আমাদের হার্টবিটের শব্দ যেমন শোনা যায়, পালসারের বিটও তেমনি দুরবিন যথেষ্ট শক্তিশালী হলে শোনা সম্ভব। মিলিসেকেন্ড পালসারের ক্ষেত্রে এরকম এক হাজার বিট এক সেকেন্ডে শোনার কল্পনা করতে হবে। এস্ট্রোনমাররা অবশ্য শব্দ শোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না, তাদের কাজ সূক্ষ্মভাবে পালসের আগমনকাল মাপা, এত সূক্ষ্মভাবে যে তাতে ভুলের পরিমাণ ন্যানোসেকেন্ড লেভেলের। পালস ট্রেন পাওয়ার পর একেকটা পালসের প্রফাইল থেকে সব ধরনের দূষণ দূর করতে হয়। দূষণের মধ্যে আছে মানুষের তৈরি সব রেডিও সিগনাল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং পালসার ও পৃথিবীর মাঝখানে থাকা সব অনাকাঙ্ক্ষিত রেডিও সোর্স। কোনো কোনো পালসারের দূরত্ব আমাদের থেকে দশ বিশ হাজার লাইটইয়ার, সুতরাং পালস পৃথিবীতে আসার পথে অনেক ধরনের দূষণের শিকার হয়। সব দূষণ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা যায় পালসের ‘ডেটা’। এর পাশাপাশি প্রতিটা পালসারের জন্য তাত্ত্বিকভাবে পালসের এমন একটা ‘মডেল’ বানানো হয় যার মধ্যে মহাতরঙ্গের কোনো প্রভাব নেই।
ডেটার মধ্যে যেহেতু মহাতরঙ্গের প্রভাব থাকার কথা সেহেতু ডেটা থেকে মডেল বাদ দিলে শুধু মহাতরঙ্গের প্রভাবটা রেসিজুয়াল হিসেবে পাওয়া যাবে। এই রেসিজুয়াল থেকেই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের কারণে আগমনকালের পার্থক্য জানা যায়। প্রতি জোড়া পালসারের আগমনকালের পার্থক্যের কোরিলেশন উপরে ন্যানোগ্র্যাভের গ্রাফে গড় করে দেখানো হয়েছে। আকাশের এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত বিভিন্ন কোণে অবস্থিত পালসার জোড়ার এই কোরিলেশন যে এমন একটা কার্ভ অনুসরণ করবে তা ক্যালটেকের বিজ্ঞানী হেলিংস ও ডাউন্স ১৯৮০র দশকে দেখিয়েছিলেন। এই কার্ভের নাম সে-কারণে হেলিংস-ডাউন্স বা এইচডি কার্ভ। ডেটার সব পয়েন্ট একটা তাত্ত্বিক কার্ভের এত কাছে আনতে পারা যেকোনো বিজ্ঞানীর স্বপ্ন।
ইউনিভার্সের প্রথম একশ কোটি বছরের ইতিহাস বোঝার পথে আইপিটিএ’র আবিষ্কার একটি মাইলফলক। মাত্র এক দশক আগেও মহাবিশ্বের শৈশব এভাবে জানার কথা আমরা ভাবতে পারতাম না। বিগব্যাঙের চার লক্ষ বছর পর ইউনিভার্সের চেহারা কেমন ছিল জানতাম, কিন্তু তার পর হাইড্রোজেন গ্যাস কিভাবে এক বিলিয়ন বছরের মধ্যে লক্ষ কোটি গ্যালাক্সিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল, আর প্রত্যেক গ্যালাক্সির গর্ভে কিভাবে ভয়ংকর ভারী ব্ল্যাকহোলের ঠাঁই হলো তা ছিল রহস্য। সেই রহস্য ভেদের জন্য এখন তড়িতরঙ্গ ও মহাতরঙ্গ একসাথে কাজ করছে। এক দিকে জেমস ওয়েব প্রথম গ্যালাক্সিগুলোর ছবি তুলছে, অন্য দিকে লোফার ও হেরা‘র মতো দুরবিন আদিম হাইড্রোজেন থেকে আসা নিম্ন কম্পাঙ্কের রেডিও সিগনাল ধরার চেষ্টা করছে। আর পিটিএ’র কারণে এখন থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের মাধ্যমে শোনা যাবে প্রথম গ্যালাক্সিদের যুগলনাচ ও মহামিলনের গল্প। আগামী দশকে স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারে অব্জার্ভেটরির কাজ শেষ হলে এক দুরবিন দিয়ে আদি মহাবিশ্বের হাইড্রোজেন দেখা যাবে এবং মহাতরঙ্গের গুঞ্জন শোনা যাবে।