- English
- বাংলা
Table of Contents
১. পার্টিকেল যুগ
সক্রেটিস: ব্রহ্মপুত্রের জন্ম হিমালয়ের উত্তর ঢালে চিমায়ুংডুং ও আংসির মতো কিছু গ্লেসিয়ার থেকে, যারা এই মানস সরোবর থেকে মাত্র ৭১ কিমি পূর্ব দিকে। এসব গ্লেসিয়ার থেকে অনেক নদীই বের হয়ে এক স্রোতে মিশে সাংপো নদী তৈরি করে। একটা নদীর উৎস বের করা যত কঠিন, ইউনিভার্সের উৎস বের করা তার চেয়ে অন্তত ২৪ গুণ কঠিন।
রবি: বুঝলাম যে তুমি কাজটা সহজ করার জন্য শুধু আংসির উপর ফোকাস করতে চাচ্ছ। কিন্তু মহাবিশ্বের পার্টিকেল যুগের বর্ণনা সহজ করা এত সোজা হবে না। পার্টিকেল ফিজিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেল গাণিতিকভাবে না বুঝলে এটা বুঝা সম্ভব না।
সক্রেটিস: প্রাচীন ইন্ডিয়ানরা বলত, মহাবিশ্বের ভিত্তি হলেন ব্রহ্ম, ব্রহ্মের মন থেকে তৈরি হয়েছে মানস সরোবর, আর ব্রহ্মের ছেলে হলেন ব্রহ্মপুত্র। মানস সরোবরে এত বার এসেও জুনো যেহেতু ব্রহ্মের মন বুঝতে পারেনি, সেহেতু মনে হয় না আমরাও স্ট্যান্ডার্ড মডেলের গাণিতিক রূপ বুঝতে পারব, তা তোমার সাথে যতই কথা বলি।
জুনো: এত কথা বাদ দিয়ে সবাই চলো ব্রহ্মপুত্রের কথিত উৎসে চলে যাই। বরফের উপর বসে কথা বললে আশাকরি রবির আগুন কিছুটা কমবে।
সক্রেটিস: কোথায় এই ‘কথিত’ উৎস?
হার্মিস: ল্যাটিচুড ৩০.৩৪৮, লঙ্গিচুড ৮২.০৪৫, মানে বিষুবরেখা থেকে ৩০ ডিগ্রি উত্তরে, আর ইংল্যান্ডের গ্রিনিচের উপর দিয়ে যাওয়া প্রাইম মেরিডিয়ান থেকে ৮২ ডিগ্রি পূর্বে। মনে রাখতে হবে বিষুবরেখা থেকে উপরে উত্তর মেরু পর্যন্ত দূরত্ব ৯০ ডিগ্রি, আর প্রাইম মেরিডিয়ান থেকে বিষুবরেখা বরাবর পুরা পৃথিবী ঘুরে আবার গ্রিনিচে ফিরে আসলে মোট ৩৬০ ডিগ্রি দূরত্ব অতিক্রম করা হয়। তাহলে ৩০ ডিগ্রি হলো নব্বইয়ের তিন ভাগের এক ভাগ, আর বিরাশি ডিগ্রি হলো ৩৬০ ডিগ্রির চার ভাগের প্রায় এক ভাগ।
[হার্মিসের অদরকারি কথা শোনার সময় সবাই উড়াল দিয়ে চলে আসে আংসি নদীর উৎসে। আংসির তীরে বরফের উপরে বসে সবাই রবির কাছে শোনে পার্টিকেল যুগের কথা।]
1. বিগব্যাং থেকে স্পেসটাইম
সক্রেটিস: বিগব্যাং থিওরি, অর্থাৎ কসমোলজির স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে, আমাদের মহাবিশ্ব, মানে আমরা সবাই, প্রায় ইনফিনিটলি ক্ষুদ্র একটা বিন্দু থেকে এসেছি। দুই বিন্দুবাসিনী নিয়ে বোর্হেসের কমেডি মনে আছে তো! এখন থেকে প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে এক বিন্দু থেকে স্থানকাল প্রসারিত হতে শুরু করেছিল, এই ঘটনার নাম বিগ ব্যাং। বিগব্যাঙের বিস্ফোরক এনার্জির কারণে এই প্রসারণ এখনো চলছে, আমাদের মহাবিশ্ব এখনো দিন দিন বড় হচ্ছে। কিন্তু এই কথা আমি অলিম্পাসের দেবতাদেরকে যখনি বলতে যাই তারা প্রশ্ন করেন, এই বিগব্যাঙের আগে কি ছিল বা এই বিগব্যাং কিভাবে হলো? দেবতারাই যদি এমন প্রশ্ন করে, নশ্বরদের কি হবে?
রবি: স্পেসটাইমের জন্মই যদি বিগব্যাঙের সময় হয়ে থাকে তাহলে, বিগব্যাঙের আগে কি ছিল, বা বাইরে কি ছিল সেই প্রশ্নের কোনো অর্থ থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিগব্যাং থেকে তৈরি আমাদের স্পেসটাইম ছাড়া আসলেই কি আর কোনো স্পেসটাইম থাকতে পারে না? এমনকি হতে পারে যে প্রকৃতি আসলে একটা মাল্টিভার্স যেখানে অনেক বা অসীম সংখ্যক চারমাত্রিক ইউনিভার্স আছে? স্থানের তিন মাত্রা ও সময়ের এক মাত্রা একসাথে করে আমরা যে চার মাত্রা চিন্তা করছি তার বাইরে কি কিছু নাই? আমাদের চারটা মাত্রার জন্ম কি আরো বেশি মাত্রার অন্য এক জগৎ থেকে হতে পারে? এসবের উত্তর আমরা এখনো জানি না, জানার চেষ্টা হিসেবে অনেক গাণিতিক থিওরি বানানো হয়েছে, কিন্তু কোন থিওরি বা মডেল সঠিক তা অব্জার্ভেশনের মাধ্যমে এখনো প্রমাণ করা যায়নি। স্ট্রিং থিওরিতে অনেক মাত্রা ইউজ করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
সক্রেটিস: বুঝলাম যে বিগব্যাঙের পরে কি হয়েছে আমরা জানি, কিন্তু স্বয়ং বিগব্যাঙের কারণ বা গাণিতিক ভিত্তি এখনো অজানা। গাণিতিক থিওরিগুলা কি ইউনিভার্সের অংশ, না বাইরে থেকে ইউনিভার্সের উপর চাপিয়ে দেয়া আইন?
রবি: ভালো প্রশ্ন। তোমার স্টুডেন্ট প্লেটো আর তার স্টুডেন্ট এরিস্টটল এটা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু করে গিয়েছিলেন তা এখনো চলছে। রজার পেনরোজের বানানো এই ফিগার দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায়। প্রকৃতিতে বা বাস্তবতায় তিনটা জগৎ কল্পনা করা যায়: গাণিতিক, ফিজিকেল, মানসিক। গাণিতিক জগতে অসংখ্য জিনিস আছে (গণিতের সবকিছু), কিন্তু তার সামান্য কয়েকটা (যেমন, ফিজিক্সের মৌলিক তত্ত্ব) পুরা ফিজিকেল জগৎ তৈরি করে, বা নিয়ন্ত্রণ করে, যা ছবিতে ‘1’ দিয়ে চিহ্নিত তীরের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। একইভাবে ফিজিকেল জগতে অসংখ্য জিনিস আছে (গরিলা থেকে গ্যালাক্সি), যার সামান্য কয়েকটা (যেমন, আমাদের ব্রেইন) পুরা মানসিক জগৎ তৈরি করে, বা নিয়ন্ত্রণ করে, যা ‘2’ দিয়ে দেখানো হয়েছে। এবং মানসিক জগতেও অসংখ্য জিনিস আছে (সব প্রাণীর সব চিন্তা), যার সামান্য কয়েকটা (থিওরিস্টদের কিছু চিন্তা) গাণিতিক জগৎকে ধারণ করতে পারে, যা ‘3’ দিয়ে দেখানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই চক্রে কোন জগৎটা প্রথম, কোন জগৎ থেকে বাকি দুই জগতের জন্ম বা শুরু, না কি তিনটাই একসাথে থাকে? প্লেটোর মতে গাণিতিক বা ফর্মাল জগৎ থেকে সবকিছুর শুরু, এরিস্টটলের মতে সবার আগে ফিজিকেল জগৎ, আর বিশপ বার্কলির মতে মানসিক জগৎ থেকে সবকিছুর জন্ম।
সক্রেটিস: তার মানে প্লেটো মনে করত ইউনিভার্স না থাকলেও সব থিওরি থাকবে, কারণ থিওরি ইউনিভার্সের বাইরে আলাদাভাবে গাণিতিক জগতে থাকে।
রবি: হ্যাঁ। আর এরিস্টটলের মতে থিওরি হচ্ছে ইউনিভার্সের বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য মানুষের বানানো মডেল। মহাবিশ্ব না থাকলে তত্ত্বও থাকবে না।
সক্রেটিস: আমাদের ইউনিভার্সের ক্ষেত্রে কিন্তু এরিস্টটলের বস্তুবাদই সবচেয়ে সঠিক মনে হয়।
রবি: সেটা তোমার নিজস্ব চয়েজ। আমি প্লেটোবাদী। ম্যাথের বিউটি আর থিওরির অর্থ যে বুঝতে পেরেছে তার পক্ষে ম্যাথ ছাড়া অন্য কিছুকে উৎস ভাবা সম্ভব না।
সক্রেটিস: আচ্ছা, তাহলে এই তিন জগৎ মিলিয়ে বাস্তবতার মৌলিক গাঠনিক উপাদান কি কি বলা যায়?
রবি: অবশ্যই স্টেমিক, মানে স্পেস, টাইম, এনার্জি, ম্যাটার, ইনফর্মেশন, ও চেতনা।
সক্রেটিস: তোমার ম্যাথ কোথায়?
রবি: ম্যাথের সবকিছু ওই ইনফর্মেশনের ভিতরে আছে।
সক্রেটিস: চেতনা আলাদা করার কি দরকার ছিল? মানসিক সবকিছুও তো ইনফর্মেশনের মধ্যে পড়ে।
রবি: অনেক কগ্নিটিভ বিজ্ঞানীই মনে করেন চেতনা অন্য টাইপের জিনিস, ইনফর্মেশন না। কিন্তু সেটা অন্য বিতর্ক। আমাদের প্রথমে ফোকাস করা উচিত স্টেমিকের শুধু ‘স্টেম’ নিয়ে, মানে স্পেস, টাইম, এনার্জি ও ম্যাটারের উপর।
সক্রেটিস: এই চারটা একসাথে ব্যাখ্যা করা যায় রেলেটিভিটি দিয়ে, কিন্তু কেবল অনেক বড় স্কেলে। অনেক ছোট এটমিক বা সাবেটমিক স্কেলে রেলেটিভিটি খাটে না, সেখানে এনার্জি ও ম্যাটার ব্যাখ্যা করতে হয় কোয়ান্টাম থিওরি দিয়ে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে জেনারেল রেলেটিভিটি মিশিয়ে যদি একটা থিওরি বানানো যায় তাহলে স্টেম সব স্কেলেই একসাথে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একটা থিওরি অফ এভ্রিথিং (টো) বানানোর চেষ্টা অনেক ফিজিসিস্ট এখনো করে যাচ্ছেন, তুমিও তাদের একজন না কি?
রবি: আমি এখনো মনে করি স্ট্রিং থিওরির ভবিষ্যৎ কোনো একটা ভার্সন সবকিছু ইউনিফাই করতে পারবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই তোমরা বুঝবে না। বরং আমাদের এখন দেখা উচিত ইউনিফাই করা মানে কি, আর টো’র মধ্যে এই ‘এভ্রিথিং’ আসলে কি?
সক্রেটিস: তাহলে আমাদেরকে বলো এভ্রিথিং মানে কি, আর ইউনিফাই করা মানে কি।
2. এনার্জির জন্ম
রবি: বর্তমানে আমাদের ইউনিভার্সে এনার্জি আছে চার রকমের। একেক এনার্জির ইন্টারেকশন একেক রকম। এনার্জির ইন্টারেকশনকে আমরা ফোর্স বলি। তাহলে চার এনার্জির সাথে সম্পর্কিত ফোর্সও আছে চারটা: স্ট্রং, ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক, উইক, আর গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স।
সক্রেটিস: হ্যাঁ, তোমার এই ফিগারে তাই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তুমি স্টেমের স্পেস, টাইম, ম্যাটার বাদ দিয়ে এনার্জি দিয়ে শুরু করলে কেন?
রবি: কারণ, সক্রেটিস, বিগব্যাঙের পর শুরুতে শুধু স্পেসটাইম আর এনার্জি ছিল, ম্যাটার পরে এনার্জি থেকে তৈরি হয়েছে; এটা আইনস্টাইনের $E=mc^2$ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, যদি $E$তে এনার্জি আর $m$তে ম্যাটার বুঝাও, $c$ তো আলোর বেগ। ম্যাটারের কথায় আমরা পরে যাব। ফিগারে দেখো, চার ধরনের এনার্জি বা ফোর্স স্বাধীন অস্তিত্ব পেয়েছে ইউনিভার্সের ইতিহাসের প্রথম ১ পিকোসেকেন্ডের মধ্যে। এক পিকোসেকেন্ড মানে এক সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ।
সক্রেটিস: ম্যাটার এখন না বুঝলেও ম্যাটার করে না, কিন্তু স্পেসটাইমের জন্ম কিভাবে হলো সেটা না বলেই এনার্জিতে চলে যাবে?
রবি: শূন্য টাইম বলে কিছু আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না। প্লাংক টাইমে গিয়ে আমাদের সব থিওরি ভেঙে পড়ে। প্লাংক টাইম হলো এক সেকেন্ডের ১ কোয়াটোরডেসিলিয়ন (একের পরে ৪৫টা শূন্য) ভাগের এক ভাগ, তার মানে $10^{-45}$ সেকেন্ড। প্লাংক টাইমের পর থেকেই স্পেসটাইম ছিল, আর তার সাথে শুধু একটা ইউনিফাইড এনার্জি ও ফোর্স ছিল। এর নাম টো ফোর্স, কারণ কোনোদিন থিওরি অফ এভ্রিথিং আবিষ্কার করা গেলে সেই থিওরি দিয়ে এই ফোর্স ব্যাখ্যা করা যাবে।
রিয়া: দাঁড়াও, তোমার ফিগারে সময় আর টেম্পারেচারের ব্যাপারটা তো বুঝতে পারছি না। কালচারাল যুগে অভ্যস্ত আমি এত ছোট সংখ্যা হজম করতে অনেক কষ্ট পাচ্ছি। এই টো ফোর্সের যুগে মহাবিশ্বের বয়স আর তাপমাত্রা কত ছিল?
রবি: মনে রেখো, প্রথম পিকোসেকেন্ডেই সব ফোর্সের জন্ম হয়ে গেছে। টো ফোর্সের অস্তিত্ব ছিল এর চেয়েও অনেক আগে, যখন মহাবিশ্বের বয়স ছিল ১ সেকেন্ডের ১০ ‘ট্রেডেসিলিয়ন’ ভাগের এক ভাগের চাইতেও কম। সংখ্যা নামের আর্টিকেলে গেলে ছোট ও বড় সংখ্যার নামের একটা লিস্ট পাবে। এই লিস্টের উপর মাঝেমাঝে মেডিটেশন করলে এই ধরনের সংখ্যা অনুভব করতে পারবে।
রিয়া: লিস্টে যা দেখছি, ১ ট্রেডেসিলিয়ন মানে একের পরে ৪২টা শূন্য, তাহলে ১০ ট্রেডেসিলিয়ন মানে একের পরে ৪৩টা শূন্য। একের পরে মাত্র বারোটা শূন্য বসালেই এক ট্রিলিয়ন হয়ে যায়, আর এখানে বসাতে হবে ৪৩টা। এক সেকেন্ডকে এত বড় সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যে ভয়ানক ছোট্ট সময় আসবে সেটা কোনো মানুষের পক্ষে অনুভব করা অসম্ভব। আর টেম্পারেচার অনুভব করার চেষ্টাও করতে চাই না।
রবি: এই বরফের মধ্যে বসে সেই সময় মহাবিশ্বের টেম্পারেচার কত ছিল তা ভাবতে অন্যরকম ভালো লাগার কথা। ভেবে দেখো। ব্রহ্মপুত্রের উৎস অনেক ঠাণ্ডা, যত মোহনার দিকে (বঙ্গোপসাগরের দিক) যাব তাপমাত্রা তত বাড়বে। ইউনিভার্সের ক্ষেত্রে উল্টা। বিগব্যাঙের সময় টেম্পারেচার ছিল সবচেয়ে বেশি, তার পর থেকে ইউনিভার্স যত প্রসারিত হয়েছে, তার ডেন্সিটি ও টেম্পারেচার দুইটাই তত কমেছে, এখনো কমছে।
রিয়া: এই ফিগার আর নাম্বারের লিস্ট মিলিয়ে দেখলে বলতে পারি, ইউনিভার্সের বয়স যখন এক সেকেন্ডের ১০ ট্রেডেসিলিয়ন ভাগের এক ভাগ ($10^{-43}$ সেকেন্ড), আর টেম্পারেচার যখন ১০০ ননিলিয়ন কেলভিন ($10^{32}$ K), তখন টো ফোর্স ভেঙে দুইটা আলাদা ফোর্সের জন্ম হয়েছে, গ্র্যাভিটি আর গাট ফোর্স। ‘গাট’ মানে কি?
রবি: ‘গাট’ মানে গ্র্যান্ড ইউনিফাইড থিওরি। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে পাকিস্তান থেকে নির্বাসিত বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম এই থিওরি আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, গ্ল্যাশো আর ওয়াইনবার্গের সাথে। এটাই এখন পর্যন্ত প্রমাণিত টো’র সবচেয়ে কাছের থিওরি। মহাবিশ্বের বয়স যখন এক সেকেন্ডের ১০০ ডেসিলিয়ন ভাগের এক ভাগ, আর তাপমাত্রা যখন ১ অক্টিলিয়ন ডিগ্রি, তখন গাট ফোর্স থেকে দুইটা স্বাধীন ফোর্স জন্মায়: স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ও ‘ইলেক্ট্রোউইক’ ফোর্স। আর সব শেষে এক পিকোসেকেন্ড বয়সে, এক কোয়াড্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রায় ইলেক্ট্রোউইক ফোর্স ভেঙে শেষ দুই স্বাধীন ফোর্স তৈরি করে: ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফোর্স এবং উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স।
রিয়া: চার ফোর্সের নামের বাম দিকে দেখি কিছু পার্টিকেলের নাম লেখা, আর ডান দিকে কিছু সংখ্যা আর ছবি। এসবের অর্থ কি?
রবি: যারা ম্যাথের মাধ্যমে কিছু বুঝতে পারবে না তাদের সুবিধার জন্য এগুলো এই চার ফোর্সের একটা প্রাথমিক পরিচিতি। প্রত্যেক ফোর্স কাজ করে নির্দিষ্ট পার্টিকেল আদান-প্রদানের মাধ্যমে। স্ট্রং ফোর্সের বা ইন্টারেকশনের কণা হলো গ্লুয়ন, ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফোর্সের ফোটন, এবং উইক ফোর্সের জন্য তিন ধরনের বোসন, যেমন, জেড বোসন। গ্র্যাভিটির জন্য এই রকম কণা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তবে মানুষ যেমন বাচ্চা নেয়ার আগেই নাম ঠিক করে রাখে, তেমনি ভবিষ্যৎ আবিষ্কারের আশায় বিজ্ঞানীরা এর নাম ঠিক করে রেখেছেন ‘গ্র্যাভিটন’। স্ট্রং ফোর্স সবচেয়ে স্ট্রং, এর শক্তি ১ ধরে বাকিদের শক্তি এর সাথে তুলনা করা হয়েছে ফিগারের ডান দিকে। স্ট্রং ফোর্সের তুলনায় ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফোর্স ১০০ গুণ দুর্বল, উইক ফোর্স ১ মিলিয়ন গুণ দুর্বল, আর গ্র্যাভিটি ১ ডুওডেসিলিয়ন গুণ দুর্বল।
রিয়া: কিন্তু সবচেয়ে বেশি বুঝা দরকার কোন ফোর্সটা আসলে কি।
রবি: সেটাই একেবারে ডানের চার ছবিতে দেখানো হয়েছে। স্ট্রং আর উইক ফোর্স এটমের নিউক্লিয়াসের ভিতরেই শুধু কাজ করে। স্ট্রং ফোর্স তিনটা কোয়ার্ক জোড়া লাগিয়ে প্রোটন তৈরি করে। উইক ফোর্স এই প্রোটনের একটা আপ কোয়ার্ককে ডাউন কোয়ার্কে বদলে দেয়ার মাধ্যমে প্রোটনটাকে নিউট্রনে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে, এবং এভাবেই রেডিওএক্টিভিটির জন্ম হয়। ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফোর্স ইলেক্ট্রন ও প্রোটনের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করে এটম অক্ষত রাখে। আর গ্র্যাভিটি পৃথিবীর চারদিকের স্পেস বাঁকিয়ে চাঁদকে তার চারদিকে ঘুরতে বাধ্য করে।
রিয়া: কিন্তু একটা জিনিস ব্যাখ্যা করোনি। তোমার ফিগারের মাঝখানের দিকে এক পিকোসেকেন্ডের সময়ে লেখা আছে ‘ইলেক্ট্রোউইক সিমেট্রি ব্রোকেন’, এর মানে কি?
রবি: এটাই সবচেয়ে জরুরি জিনিস। আমি চার এনার্জির বা ফোর্সের জন্মের সিকোয়েন্সটা বললাম, কিন্তু কেন এইভাবে একটা থেকে ভেঙে চারটা হলো তা বলিনি। কারণটাকে ফিজিক্সে বলে সিমেট্রির ভাঙন। ফিজিক্সের কোনো থিওরিতে সিমেট্রি থাকা মানে, সেই থিওরি সব স্পেসে ও টাইমে একইভাবে প্রযোজ্য। গ্র্যাভিটির থিওরি গাছের আপেলের জন্য যেমন খাটে, এন্ড্রমিডা গ্যালাক্সির জন্যও তেমন খাটে, এবং আজকে যতটা সত্য গতকালও ততটাই সত্য ছিল, আগামীকালও ততটাই থাকবে। এই সিমেট্রির আরো চরম একটা রূপ আছে, যেখানে এমনকি পার্টিকেলের পরিচয়ও সিমেট্রিক হয়ে যায়, যার অর্থ এক কণার সাথে আরেক কণার কোনো তাত্ত্বিক পার্থক্য থাকে না। যেমন, ইলেক্ট্রোউইক থিওরির সিমেট্রি ভাঙার আগে ফোটন আর জেড বোসনের মধ্যে পার্থক্য ছিল না, মহাবিশ্বের এক পিকোসেকেন্ড বয়সে যখন সিমেট্রিটা ভেঙে গেছে তখনি এই দুই কণা আলাদা হয়ে গেছে। একই ধরনের সিমেট্রি-ভাঙন আগেও দুই বার হয়েছে, যদিও সেগুলো আমরা ল্যাবে আবিষ্কার করতে পারিনি।
রিয়া: বুঝলাম, কিন্তু, সক্রেটিস, তোমার কি মনে হয় না রবির এই বর্ণনা বেশি তাত্ত্বিক, এবং আমরা পুরা ব্যাপারটা এখনো ভিজুয়ালাইজ করতে পারছি না?
সক্রেটিস: ঠিক।
রবি: তাহলে একটা মেটাফরের সময় এসে গেছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সিমেট্রি ভেঙে যাওয়ার কারণ আসলে ফেইজের পরিবর্তন। যেমন, ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি গ্যাস হিসেবে থাকে। টেম্পারেচার কমাতে থাকলে ১০০ ডিগ্রির আগ পর্যন্ত খুব বড় কিছু হবে না, কিন্তু ১০০ ডিগ্রিতে আসলেই পানি গ্যাস থেকে তরল হয়ে যাবে। অন্য কোনো তাপমাত্রায় না, শুধু ১০০ ডিগ্রিতেই পানির ফেইজ পাল্টাতে পারে এইভাবে। তারপর তাপমাত্রা আরো কমাতে থাকলে ০ ডিগ্রির আগ পর্যন্ত আবারো বড় কিছু হবে না, কিন্তু ঠিক ০ ডিগ্রিতে পানির ফেইজ তরল থেকে কঠিন হয় যাবে, আমরা বরফ পাব। পানির এই দুই ফেইজ পরিবর্তনের সাথে ইউনিভার্সের শেষ দুই ফেইজ ট্রাঞ্জিশনের তুলনা করা যায়। এক সেকেন্ডের ১০০ ডেসিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বয়সে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমতে কমতে ১ অক্টিলিয়ন ডিগ্রিতে যখন পৌঁছায় তখনি গাট ফোর্সের সিমেট্রি ভাঙে, আর তার পার্টিকেলের ফেইজ ট্রাঞ্জিশন ঘটে, মেটাফরিকেলি আগেরটা যদি গ্যাস হয় তবে পরেরটা হবে তরল। তারপর তাপমাত্রা আরো কমে এক পিকোসেকেন্ড বয়সে যখন ১ কোয়াড্রিলিয়ন ডিগ্রি হয়, তখন ইলেক্ট্রোউইকের সিমেট্রি ভাঙে, তার কণার আরেকটা ফেইজ ট্রাঞ্জিশন ঘটে, মেটাফরিকেলি তরল থেকে কঠিন বরফ হওয়ার মতো।
রিয়া: এবার আমি বুঝতে পারছি বেটার। কিন্তু এক অক্টিলিয়ন ডিগ্রি বয়সে যে ইনফ্লেশন লিখে রেখেছ তার একটু ব্যাখ্যা দরকার।
রবি: তরল পানি ফুটিয়ে বাষ্পে পরিণত করতে চাইলে যেমন হিট বা এনার্জি দিতে হয়, তেমনই বাষ্প জমিয়ে তরল পানিতে রূপান্তরিত করার সময় এনার্জির রিলিজ ঘটে। একইভাবে ইউনিভার্সের প্রতিটা ফেইজ ট্রাঞ্জিশন বা সিমেট্রি ব্রেকিঙের সময় প্রচুর এনার্জি বিমুক্ত হয়েছিল। এক অক্টিলিয়ন ডিগ্রিতে এনার্জির রিলিজ এত বেশি হয়েছিল যে তাতে ইউনিভার্স হুট করে অনেক বড় হয়ে যায়। এই ঘটনার নাম ইনফ্লেশন, তবে এর নিশ্চিত প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
রিয়া: এই সব ফেইজ-পাল্টানো, সিমেট্রি-ভাঙা পার্টিকেল আমাদের আরো ভালো চিনতে হবে।
3. ম্যাটারের জন্ম
রবি: তার জন্যই আমাদেরকে এখন নিচের ফিগারে চোখ রাখতে হবে। পার্টিকেল ফিজিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এখন পর্যন্ত যে সতেরটা কণা সম্মানের আসন পেয়েছে সেগুলো নিচে দুইভাবে দেখানো হয়েছে: বামে প্রত্যেক কণার ভর, চার্জ ও স্পিন দেয়া আছে, আর ডানে একই কণাগুলোকে অন্যভাবে সাজানো হয়েছে মডেলটার বিউটি দেখানোর জন্য।
রিয়া: এখানে তিনটা ফোর্সের ক্যারিয়ার হিসেবে পরিচিত চারটা কণাও দেখতে পাচ্ছি: গ্লুয়ন, ফোটন, জেড বোসন, ও ডব্লিউ বোসন, প্রত্যেকের স্পিন ১। স্ট্রং আর ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফোর্সের মধ্যে দেখি মিল আছে, কারণ তাদের কণার কোনো ভর ও চার্জ নাই। উইক ফোর্সের দুই কণা অনেক ভারী, ভর একটার ৯১ আরেকটার ৮০ জিইভি, কিন্তু ভরের এই ইউনিটের অর্থ কি? বুঝলাম যে জিইভি মানে গিগা ইলেক্ট্রন-ভোল্ট, কিন্তু সেটা তো এনার্জির ইউনিট হওয়ার কথা।
রবি: এনার্জি আর ম্যাটার (ভর) যে একই জিনিস তা তো আইনস্টাইনের সমীকরণ দিয়ে একটু আগেই বলেছি। ইলেক্ট্রন-ভোল্ট এনার্জির একক, কিন্তু সেটাকে আলোর বেগের বর্গ দিয়ে ভাগ করলেই ভর চলে আসবে। কিন্তু আমাদের জন্য আসল ভরের চেয়ে তুলনা বেশি জরুরি। এজন্য মেগা আর গিগার অর্থটা মনে রাখতে হবে: মেগা মানে মিলিয়ন, আর গিগা মানে বিলিয়ন। রিয়া, তাহলে তুমি কি পুরা মডেলটা একবার বর্ণনা করবে?
রিয়া: বামের ফিগার আগে দেখি। এখানে বাম দিকে ম্যাটারের ১২টা কণা যাদের সাধারণ নাম ফার্মিয়ন, ইতালির এনরিকো ফের্মির নামে, আর ডানে এনার্জির ৫টা কণা যাদের সাধারণ নাম বোসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে। এনার্জির কণাদের স্পিন ১, ম্যাটারের কণাদের স্পিন ১/২। এনার্জির কণাদেরকে ইন্টারেকশন বা ফোর্সের ক্যারিয়ার বলে। হিগস বোসনকে বলে স্কেলার বোসন, আর বাকি চারটাকে গেইজ বোসন, বা ভেক্টর বোসন। স্কেলার ও ভেক্টর বুঝলেও এসব নামের অর্থ আমার বুঝার দরকার নাই। বোসনদের মধ্যে হিগস সবচেয়ে ভারী, আর গ্লুয়ন ও ফোটন একদম ভরহীন। ম্যাটারের কণা দুই রকমের: ছয়টা কোয়ার্ক আর ছয়টা লেপ্টন। কোয়ার্ক ছয়টার নাম খুব সুন্দর: আপ, চার্ম, টপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, বটম। প্রথম তিনটার চার্জ হলো ২/৩, পরের তিনটার চার্জ -১/৩। লেপ্টন ছয়টার নাম ইলেক্ট্রন, মিউয়ন, টাউ, ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো, টাউ নিউট্রিনো। প্রথম তিনটার চার্জ -১, আর নিউট্রিনো তিনটার চার্জ ০, তারা নিউট্রাল। সবচেয়ে ভারী কোয়ার্ক টপ, আর সবচেয়ে হালকা আপ। সবচেয়ে ভারী লেপ্টন হলেন টাউ, আর সবচেয়ে হালকা হলো ইলেক্ট্রন, আমাদের সবচেয়ে আদরের জিনিস।
রবি: দারুণ বর্ণনা, ব্যাখ্যা না, বর্ণনা। এসবের ব্যাখ্যা কেবল ম্যাথ দিয়েই করা যায়, যা অবশ্যই আমরা বাদ দিচ্ছি। এই মডেলে ম্যাটারের কণাদেরকে (ফার্মিয়ন) ইট, আর ফোর্সের কণাদেরকে (বোসন) সিমেন্ট হিসেবে চিন্তা করতে পারো। সিমেন্ট দিয়ে ইট জোড়া লাগিয়ে যেমন দেয়াল বানানো যায়, তেমনি বোসন দিয়ে ফার্মিয়ন জোড়া লাগিয়ে ইউনিভার্সের যেকোনো জিনিস বানানো যায়।
রিয়া: কিন্তু সক্রেটিসকে শুরুতেই বলেছিলে তুমি এনার্জি থেকে ম্যাটারের জন্ম ‘বর্ণনা’ করবে। আমি বুঝেছি যে বোসনরা সব টো ফোর্সের কণা থেকে সিমেট্রি ভাঙার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিগব্যাঙের পর ফার্মিয়নগুলি ঠিক কখন কিভাবে তৈরি হয়েছিল?
রবি: ভালো প্রশ্ন। এনার্জি আর ম্যাটার যেহেতু ইকুইভ্যালেন্ট, বিগব্যাঙের পর একটা থেকে আরেকটা তৈরি হচ্ছিল সারাক্ষণ। এই ঘটনার নাম ‘পেয়ার প্রডাকশন’ যা এই ফিগার দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করব। এনার্জি বা ফোর্সের দুইটা কণা থেকে ম্যাটারের একটা পার্টিকেল ও একটা এন্টিপার্টিকেল তৈরি হতে পারে। এতে কোনো কনজার্ভেশন ল ভাঙা হয় না, কারণ বিক্রিয়ার আগে ও পরে জিনিসপাতির মোট পরিমাণ সমান থাকে।
রিয়া: তাহলে বর্তমান সময়েও কি এনার্জি থেকে এভাবে ম্যাটার ও এন্টিম্যাটার তৈরি হতে পারে?
রবি: না। কারণ পেয়ার প্রডাকশনের মাধ্যমে ম্যাটার বানাতে অনেক এনার্জি লাগে, তার জন্য তাপমাত্রা অনেক বেশি হতে হয় যা বর্তমানে এমনকি তারার কেন্দ্রেও নাই, কিন্তু বিগব্যাঙের ঠিক পরে ইউনিভার্স ছিল যথেষ্ট গরম। ইলেক্ট্রনের এন্টিপার্টিকেলের নাম পজিট্রন। একটা ইলেক্ট্রন-পজিট্রন পেয়ার বানানোর জন্য টেম্পারেচার লাগে ১০ বিলিয়ন কেলভিন, প্রোটন-এন্টিপ্রোটন পেয়ার বানাতে লাগে ১০ ট্রিলিয়ন কেলভিন, এবং বিভিন্ন কোয়ার্ক-এন্টিকোয়ার্ক পেয়ার বানাতে লাগে প্রায় ১ কোয়াড্রিলিয়ন কেলভিন। মহাবিশ্বের তাপমাত্রা যেহেতু এক পিকোসেকেন্ড বয়সেই ছিল এক কোয়াড্রিলিয়ন, সেহেতু কোয়ার্কদের জন্ম হয়েছে প্রথম ১ পিকোসেকেন্ড থেকে ১ ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে। তারপর ১ মাইক্রোসেকেন্ড বয়সে এনার্জি থেকে তৈরি হয়েছে প্রোটন, যার ভিতরে থাকে দুইটা আপ কোয়ার্ক ও একটা ডাউন কোয়ার্ক থাকে। আর ইলেক্ট্রনের জন্ম হয়েছে যখন মহাবিশ্বের বয়স ছিল প্রায় ১ সেকেন্ড।
রিয়া: ইন্টারেস্টিং। কিন্তু তুমি শুধু ম্যাটারের পার্টিকেলদের কথা বললে। এই প্রত্যেক ক্ষেত্রে কি আমরা একইসাথে এন্টিম্যাটারের এন্টিপার্টিকেলও পাইনি?
রবি: হ্যাঁ, ম্যাটারের সাথে সব সময় এন্টিম্যাটারও তৈরি হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, একদম শুরু থেকেই কোনো এক অজানা কারণে ইউনিভার্সে এন্টিম্যাটারের চেয়ে ম্যাটার একটু বেশি ছিল। এখন ফিগারে তো দেখেছ যে, এনার্জি থেকে ম্যাটার-এন্টিম্যাটার যেমন হতে পারে, তেমনি ম্যাটার-এন্টিম্যাটার একে অপরকে পুরাপুরি ধ্বংস করে আবার এনার্জিতে ফিরে যেতে পারে। এনাইহিলেশন নামে পরিচিত এই ধ্বংসযজ্ঞও চলছিল। কিন্তু এন্টিম্যাটারের চেয়ে ম্যাটার একটু বেশি ছিল বলে সব এন্টিম্যাটার ধ্বংস করে দেয়ার পরও কিছু ম্যাটার রয়ে গেছে। সব এন্টিকোয়ার্ক ধ্বংস করার পরও টিকে ছিল অনেক কোয়ার্ক, সব এন্টিপ্রোটন এনাইহিলেট করার পরও বেঁচে ছিল অনেক প্রোটন, আর সব পজিট্রন বিনাশ করার পরও টিকে ছিল অনেক ইলেক্ট্রন।
রিয়া: এই সব এনাইহিলেশন থেকে তৈরি হওয়া এনার্জি কোথায় গেল? যেমন ধরো, ইলেক্ট্রন-পজিট্রনের সব এনাইহিলেশনে তৈরি ফোটনরা কোথায়?
4. ফোটনের পটভূমি
রবি: চমৎকার প্রশ্ন। এই হলো সেই সব ফোটন, এদের নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি। এই ফোটনগুলো দিয়েই আমরা তুলতে পেরেছি ইউনিভার্সের প্রথম ছবি, সেই সময়ের ছবি যখন তার বয়স ছিল তিন লাখ বছর, তার তাপমাত্রা ছিল ৩,০০০ কেলভিন।
রিয়া: কিন্তু তুমি ইউনিভার্সের ১ সেকেন্ড বয়সে পজিট্রনের সাথে যুদ্ধে ইলেক্ট্রনের বিজয় থেকে লাফ দিয়ে তিন লাখ বছর বয়সে চলে গেলে। মাঝখানে কি হয়েছে?
রবি: আচ্ছা আমি একটু ব্যাকে যাই। আসলে এই বরফের উপর বসে থেকে মাথা জমে গেছে। আমরা কি আংসি নদীর বরফ-গলা পানির উপর একটু হাঁটতে পারি না? যিশুও তো পানির উপর হেঁটেছিলেন।
হার্মিস: চলো, সবাই। এরিস্টটলের পেরিপেটেটিকদের মতো আমরা কথা বলতে পারি পানির উপর হাঁটার সময়।
রবি: পায়ে বরফ-গলা পানির স্পর্শ পেয়ে মাথা খুলেছে। ইউনিভার্সের ১ সেকেন্ড থেকে ১০ মিনিট বয়সে সবচেয়ে বড় যে-ঘটনাটা ঘটেছে তা হলো নিউক্লিওসিন্থেসিস, মানে প্রোটন-নিউট্রন জোড়া দিয়ে এটমের ভারী নিউক্লিয়াস নির্মাণ। এটা আমাদের আগের বিল্ডিং প্রজেক্টেরই অংশ, সিমেন্ট দিয়ে ইট জোড়া দেয়ার মতো। পিরিয়ডিক টেবিলে যে ৯২টা এলিমেন্ট আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সিম্পল হাইড্রোজেন এটম। একটা এটমের পরিচয় নির্ধারিত হয় তার নিক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা দিয়ে। একটা নিঃসঙ্গ প্রোটনকেই হাইড্রোজেন বলা যায়, তার সাথে ইলেক্ট্রন না থাকলেও। কিন্তু পরের এলিমেন্ট হিলিয়াম বানাতে হলে দরকার দুইটা প্রোটন ও দুইটা নিউট্রন। মহাবিশ্বের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম নির্মাণের প্রসেসটা (যার নাম নিউক্লিয়ার ফিউশন) এই ফিগারে দেখানো হয়েছে।
রিয়া: কিন্তু প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই কেন?
রবি: কারণটা আবারও টেম্পারেচার। ফিউশনের মাধ্যমে হিলিয়াম বানানোর জন্য তাপমাত্রা হতে হয় অন্তত ১ বিলিয়ন কেলভিন। দশ মিনিট বয়সে এক্সপান্ডিং ইউনিভার্সের তাপমাত্রা ১ বিলিয়ন ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল, তাই শুধু প্রথম দশ মিনিটেই এই প্রসেস ঘটেছে। প্রথমে ইউনিভার্সে কেমিকেল এলিমেন্ট ছিল শুধু হাইড্রোজেন (মানে নিঃসঙ্গ প্রোটন), প্রথম দশ মিনিটে ২৪% হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়, বাকি ৭৬% হাইড্রোজেন থেকে যায়। এখনো মহাবিশ্বের কেমিকেল কম্পোজিশেন এমনই আছে। এস্ট্রোনমারদের অব্জার্ভেশনেও দেখা গেছে, আমাদের গ্যালাক্সির সবচেয়ে পুরানো তারাদের সার্ফেসে হিলিয়ামের পরিমাণ চব্বিশ পার্সেন্ট, বাকি প্রায় পুরাটাই হাইড্রোজেন।
রিয়া: হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস, মানে কেন্দ্র, না হয় তৈরি হলো। কিন্তু ইলেক্ট্রন এদের সাথে মিলে নিউট্রাল এটম কেন বানাতে পারছিল না? সেটাও কি টেম্পারেচারের কারণে?
রবি: হ্যাঁ। তাপমাত্রা বেশি হলে পদার্থের কণাদের কাইনেটিক এনার্জি (গতি) অনেক বেশি হয়। কাইনেটিক এনার্জির সাথে যুদ্ধে হেরে যায় ইলেক্ট্রন ও প্রোটনের মধ্যকার পটেনশাল এনার্জি। এজন্যই প্রথম তিন লাখ বছর ইলেক্ট্রনরা ছিল ফ্রি, তাদের সাথে প্রোটনের প্রেম ছিল না। কিন্তু ইলেক্ট্রনের সাথে তখন প্রেম ছিল ফোটনদের। ইলেক্ট্রনরা ফ্রি থাকলে ফোটনরা তাদের স্বাভাবিক সরলরেখা বরাবর চলতে পারে না, বারবার ইলেক্ট্রনের সাথে ধাক্কা খায়, স্ক্যাটার্ড হয়ে যায়। যেখানেই তাপমাত্রা বেশি সেখানেই ইলেক্ট্রন ফ্রি, আর ফোটন স্ক্যাটার্ড। সূর্যের ভিতরের বর্তমান অবস্থাও এমন। এই কারণে মহাবিশ্বের প্রথম তিন লাখ বছরকে সূর্যের মতো একটা তারার সাথে তুলনা করা যায়। সূর্যের সার্ফেসে তাপমাত্রা কয়েক হাজার কেলভিন, আর তুমি যত কেন্দ্রের দিকে যাবে টেম্পারেচার বাড়তে বাড়তে কয়েক মিলিয়ন কেলভিন হবে। তেমনি তিন লাখ বছর বয়সে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল কয়েক হাজার, সেখান থেকে যত বিগব্যাঙের দিকে যাবে টেম্পারেচার তত বাড়বে।
রিয়া: এবং যদি বর্তমানের দিকে আসতে থাকি তাহলে দেখব, মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব দিন দিন কমছে।
রবি: হ্যাঁ। এবং তাপমাত্রার সাথে এনার্জির ডেন্সিটি ম্যাটারের ডেন্সিটির তুলনায় বেশি তাড়াতাড়ি কমছিল। এই কারণেই মহাবিশ্বের বয়স যখন ৫০ হাজার বছর ছিল তখন এনার্জির ডেন্সিটি ম্যাটারের চেয়ে কমে যায়। প্রথম পঞ্চাশ হাজার বছর ছিল এনার্জির রাজত্ব, তার পর থেকে শুরু হয়েছে ম্যাটারের রাজত্ব।
রিয়া: আর ঠিক তিন লাখ বছর বয়সে কি হয়েছে?
রবি: তখন তাপমাত্রা প্রায় ৩ হাজার কেলভিনে নেমে আসায় ইলেক্ট্রন আর ফ্রি থাকতে পারেনি। প্রোটন তার পটেনশাল এনার্জি দিয়ে ইলেক্ট্রনকে বেঁধে ফেলে, তৈরি হয় নিউট্রাল হাইড্রোজেন এটম। তার পরে হিলিয়াম এটমেরও জন্ম হয়। এবং আর কোনো ফ্রি ইলেক্ট্রন না থাকায় ফোটন সরল পথে তার মুক্ত যাত্রা শুরু করে। ঘটনাটা ঠিক তিন লাখ বছর বয়সে ঘটেনি, ঘটেছে তিন লাখ থেকে এক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত একটা বড় সময়ে, কিন্তু কাব্যিক কারণে আমি তিন লাখ ইউজ করছি।
রিয়া: আচ্ছা বুঝলাম তোমার ওই ফিগারের সিএমবি কি জিনিস। এটাকে কেন একটা ব্যাকগ্রাউন্ড বলা হচ্ছে তা বুঝাই যায়, কারণ এটা আমাদের তোলা মহাবিশ্বের প্রথম ছবি, তার মানে সবচেয়ে পিছনে, সবকিছুর পটভূমিতে। ফিগারে একটা কালারবার দেখা যাচ্ছে -৩০০ থেকে +৩০০ মাইক্রোকেলভিন পর্যন্ত। সাদা-সবুজ মানে ০, যত নীলের দিকে যাব টেম্পারেচার তত নেগেটিভ হবে, আর যত লালের দিকে তত পজিটিভ হবে। এর মানে কি?
রবি: এখানে শূন্য মানে তিন লাখ বছর বয়সে ইউনিভার্সের এভারেজ টেম্পারেচার। এই এভারেজের সাপেক্ষে পুরা মহাবিশ্বের তাপমাত্রার পার্থক্য এই ম্যাপে দেখানো হচ্ছে। এটা কিন্তু পুরা ইউনিভার্সের ম্যাপ। ইউনিভার্স মানে তখন ছিল হাইড্রোজেন-হিলিয়ামের একটা সিঙ্গেল গ্যাস, যার সবখানে তাপমাত্রা প্রায় সমান, কিন্তু সামান্য ভেরিয়েশন আছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভেরিয়েশন ম্যাক্সিমাম কয়েক শ মাইক্রোকেলভিন। নীল জায়গার গ্যাস গড়ের চেয়ে একটু বেশি ঠাণ্ডা, আর লাল জায়গায় একটু বেশি গরম।
রিয়া: আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু সিএমবি’র এই ‘মাইক্রোওয়েভ’ মানে কি? এই ফোটনগুলোকে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড কেন ডাকা হচ্ছে?
5. লাইট ও কালার
রবি: সিএমবি’র রেডিয়েশন যখন ঘটেছিল তখন মহাবিশ্বের টেম্পারেচার ছিল ৩০০০ ডিগ্রি, তাই সিএমবি’র ওয়েভলেন্থ তখন ছিল ইনফ্রারেড রেঞ্জে, মানে কয়েক মাইক্রোমিটার, একটা সুইয়ের ডগার সমান। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে এই দৈর্ঘ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে হয়েছে কয়েক মিলিমিটার, আমাদের নখের পুরুত্বের সমান, যা ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক (ইএম) স্পেক্ট্রামে মাইক্রোওয়েভ রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। আমাদের এই সিএমবি ছবি তাই তুলতে হয়েছে একটা মাইক্রোয়েভ টেলিস্কোপ দিয়ে। ইএম স্পেক্ট্রামের যে ফিগার এখানে দেখছ তার নিচের দিকে নীল রং দিয়ে দেখানো হয়েছে কোন আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে কত সহজে আমাদের কাছে আসতে পারে। নীল রং এখানে অপাসিটির প্রতীক, যা নিচে ০ উপরে ১০০, অপাসিটি যত বেশি ট্রান্সপারেন্সি তত কম।
রিয়া: হ্যাঁ, তাহলে দেখা যাচ্ছে স্পেস থেকে আসা মাইক্রোওয়েভ লাইট মাটি পর্যন্ত ভালো আসতে পারে না, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তা নষ্ট করে দেয়। তাহলে সিএমবি ছবি কিভাবে তোলা হয়েছে?
রবি: ওই ছবি তোলা হয়েছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির বানানো ‘প্লাংক’ নামের একটা স্পেস-টেলিস্কোপ দিয়ে।
সক্রেটিস: আমার মনে হয় এই সুযোগে আমাদের আলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত। আলো কি? আলোর ওয়েভলেন্থ ও ফ্রিকোয়েন্সি কি জিনিস?
রবি: আলো বা লাইট হচ্ছে ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক (ইএম) এনার্জি। আলো ফোটন দিয়ে তৈরি। আলোকে আবার তরঙ্গ হিসেবেও চিন্তা করা যায়। আমরা এখন আংসি নদীর উপর দিয়ে হাঁটছি। আংসির পানিতে আমি পা দিয়ে লাথি দিলে একটা তরঙ্গ তৈরি হবে পানির সার্ফেসে। আলো তেমনি একটা তরঙ্গ যা তৈরি হয় শুধুমাত্র ইএম ফিল্ডের মধ্যে। পানিতে তরঙ্গ আমি পা দিয়েই বানাতে পারি। কিন্তু ইএম ফিল্ডে তরঙ্গ তৈরি করতে লাগে চার্জড পার্টিকেল, যেমন, ইলেক্ট্রন। একটা ইলেক্ট্রন যখন ইএম ফিল্ডে আলোড়ন জাগায় তখনি ইলেক্ট্রিক ও ম্যাগ্নেটিক ফিল্ডের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তরঙ্গ তৈরি হয়। পানিতরঙ্গের যেমন ওয়েভলেন্থ ও ফ্রিকোয়েন্সি আছে, ইএম ওয়েভ বা লাইটেরও সেসব আছে। এটা রিয়া খুব ভালো ব্যাখ্যা করতে পারে সি বিচের উদাহরণ দিয়ে।
রিয়া: সক্রেটিস, তুমি নিজেও সবকিছু খুব ভালো জানো, কিন্তু এমন একটা ভাব দেখাও যে কিছুই জানো না।
সক্রেটিস: আমার ডিমন তা মনে করে না। যাহোক, তুমি এখন তরঙ্গ তুলবে নাকি তুলবে না, বলো।
রিয়া: ওকে, কথা দিয়ে বাতাসে তরঙ্গ না তুলে আমি সরাসরি পানিতেই তরঙ্গ বানাচ্ছি। আমরা সাংপো নদীর খুব কাছে চলে এসেছি। ওই দেখো, একটা খালি নৌকা তীরে বাঁধা। আমি এই নৌকা দিয়ে মাঝ নদীতে তরঙ্গ বানাব, তোমরা সবাই তীরে দাঁড়াও পানিতে পা ডুবিয়ে যাতে তরঙ্গ আসলে ফিল করতে পারো। এই এখন আমি প্যাডেল অনেক জোরে চালাচ্ছি। সক্রেটিস, তোমার আয়রনি বাদ দিয়ে বলো, তরঙ্গ কেমন মনে হচ্ছে।
সক্রেটিস: মনে হচ্ছে ঘন ঘন আসছে, মানে তরঙ্গের এক চূড়া থেকে পরের চূড়ার দূরত্ব কম।
রিয়া: তুমি ওয়েভলেন্থ আর ফ্রিকোয়েন্সি দুটাই বুঝে ফেলেছ। পাশাপাশি থাকা দুই চূড়ার দূরত্ব হলো ওয়েভলেন্থ। এবং একটার পর আরেকটা তরঙ্গ (চূড়া) কত ঘন ঘন আসছে সেটাই ফ্রিকোয়েন্সি। আমি তো অনেক বার প্যাডেলের বেগ চেঞ্জ করলাম। তাতে তরঙ্গে কি পরিবর্তন পেয়েছ?
সক্রেটিস: হ্যাঁ। বেগ যত দ্রুত পাল্টায় তরঙ্গের ওয়েভলেন্থ তত কমে, ফ্রিকোয়েন্সি তত বাড়ে। ওয়েভলেন্থ ছোট হলে ফ্রিকোয়েন্সি বেশি হয়, ফ্রিকোয়েন্সি কম হলে ওয়েভলেন্থ বড় হয়।
রবি: চলো সবাই নৌকায় উঠে বাকি কথা শেষ করি।
[আট জন নৌকায়, সাংপো নদীতে।]
রিয়া: আমার আরো প্রশ্ন আছে ইএম স্পেক্ট্রামের ফিগারটা নিয়ে। ওয়েভলেন্থ অনুযায়ী সাজালে রেডিও লাইট সবচেয়ে লম্বা, তার পর মাইক্রোওয়েভ, ইনফ্রারেড, ভিজিবল, আল্ট্রাভায়োলেট, ও এক্স-রে, এবং সবচেয়ে ছোট গামা-রে। ওয়েভলেন্থ যত ছোট, ফ্রিকোয়েন্সি তত বেশি, এনার্জিও তত বেশি। আলোর এই বিশাল ব্যাপ্তি মানুষ কবে আবিষ্কার করেছে?
রবি: উনিশ শতক পর্যন্ত মানুষ ভিজিবল লাইট ছাড়া আর কোনো আলো চিনত না। জার্মানির দুই বিজ্ঞানী প্রথম ভিজিবল ছাড়া অন্য আলো খুঁজে পান। হাইনরিখ হের্টস ১৮৮৮ সালে রেডিও লাইট দেখেন, আর ভিলহেল্ম রন্টগেন ১৮৯৫ সালে এক্স-রে পান। তারপর রেডিও থেকে গামা-রে পর্যন্ত সব আলো ধীরে ধীরে মানুষের নাগালে আসে। আলো ধরার যন্ত্রের নাম টেলিস্কোপ। আমাদের মধ্যে একমাত্র মার্সই যেহেতু এস্ট্রোনমার ছিল সেহেতু টেলিস্কোপের আলোচনাটা তারই লিড করা উচিত।
মার্স: আমার সাথ একটা ছোট পোর্টেবল স্মার্ট টেলিস্কোপ আছে। সব ফ্রিকোয়েন্সির সব টেলিস্কোপের আচরণ এই ছোট টেলিস্কোপ দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এটা ভিজিবল লাইট ধরার টেলিস্কোপ, কাজ করে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার ওয়েভলেন্থে, অর্থাৎ আনুমানিক ৪০০ থেকে ৭০০ টেরাহার্জ কম্পাঙ্কে। কম্পাঙ্কের ইউনিট হার্জ রাখা হয়েছে হাইনরিখ হের্টসের নামেই। একেক ফ্রিকোয়েন্সির লাইটকে আমরা একেক কালার হিসেবে দেখি। আলোর ওয়েভলেন্থ ৪৫০ ন্যানোমিটার হলে তার কালার নীল, ৫৫০ ন্যানোমিটার হলে সবুজ, আর ৭০০ ন্যানোমিটার হলে লাল। লাল থেকে নীলের মধ্যে কালার আসলে সাতটা না, বরং অসীম সংখ্যক।
রবি: তাহলে রেইনবোতে মানুষ ঠিক সাতটা কালার চিন্তা করল কেন?
মার্স: আমরা ইউনিভার্সের ইতিহাসকে বা ব্রহ্মপুত্র নদকে যে-কারণে সাত ভাগে ভাগ করেছি সেই একই কারণে আইজাক নিউটন রেইনবোতে সাত কালার আরোপ করেছিলেন, মানে কাব্যিক কারণে। এই টেলিস্কোপের ছবিতেও অনেক কালার দেখা যায়। আমরা ফ্রিকোয়েন্সি ও কালার প্রতিশব্দ হিসেবে ইউজ করতে পারি।
6. টেলিস্কোপ
রবি: রাত যেহেতু এসে গেছে সেহেতু আমাদেরকে এই টেলিস্কোপের একটা ডেমনস্ট্রেশন দিয়েই দাও।
মার্স: যেকোনো আধুনিক টেলিস্কোপের মূল পার্ট তিনটা: কালেক্টর, ডিটেক্টর, প্রসেসর। এই ফিগারে তিনটাই চিহ্নিত করা আছে যা তোমরা টেলিস্কোপের সাথে মিলিয়ে নিতে পারো। ট্রাইপডের উপর ভার্টিকেল স্ল্যাবটা বসালাম তা হলো একটা এল্টিচুড-এজিমুথ মাউন্ট, যার সাথে লাগানো একটা অপ্টিকেল টিউব। টিউবের নিচের প্রান্তে আছে কালেক্টর, এক্ষেত্রে একটা ১১-সেমি ব্যাসের মিরর, আর উপরের প্রান্তে আছে ডিটেক্টর, এক্ষেত্রে একটা সিসিডি সেন্সর। প্যারাবলিক শেইপের বাঁকা মিররে পড়া সব আলো রিফ্লেকশনের পর যেখানে মিলিত হয় সেখানেই রাখা আছে সেন্সর। তীর চিহ্ন অনুসরণ করলে বুঝতে পারবে। সেন্সর আলোর সব ফোটোনকে ইলেক্ট্রনে রূপান্তরিত করে তারের মাধ্যমে প্রসেসরে পাঠায় যা রাখা আছে ভার্টিকেল মাউন্টের ভিতরে। এক্ষেত্রে প্রসেসর একটা রাস্পবেরি পাই মিনি-কম্পিউটার যাতে ৬৪ গিগা স্টোরেজ আছে, আর আছে ওয়াইফাই মডেম। কম্পিউটার অন করার সুইচ ভার্টিকেল মাউন্টের সার্ফেসেই। আর এখানে পাওয়ার আসছে যে-ব্যাটারি থেকে তা রাখা আছে মাউন্টের হরিজন্টাল অংশটার ভিতরে, ট্রাইপডের ঠিক উপরে। সুইচ অন করলে টেলিস্কোপ নিজেই একটা ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক তৈরি করবে যার সাথে আমরা ফোনের ‘ইউনিস্টেলার’ অ্যাপ দিয়ে কানেক্ট করতে পারি। এই অ্যাপ দিয়েই টেলিস্কোপটা কন্ট্রোল করতে হয়।
রবি: ছবিতে টেলিস্কোপের যেসব স্পেসিফিকেশন দেয়া আছে তাদের কি অর্থ?
মার্স: যেকোনো টেলিস্কোপের দক্ষতা নির্ধারণ করা হয় মূলত দুইটা প্যারামিটার দিয়ে: রেজলুশন আর সেন্সিটিভিটি। একটা টেলিস্কোপ সবচেয়ে ছোট যে-অব্জেক্টটা দেখতে পারে তার সাইজই তার রেজলুশন, স্পেসিফিকেশনে এটা এঙ্গুলার রেজলুশন হিসেবে দেয়া আছে। এর মান যত কম টেলিস্কোপ তত ভালো, কারণ সে তত ছোট জিনিস দেখতে পারে। এর ইউনিট এখানে আর্কসেকেন্ড। মনে রাখতে হবে একটা বৃত্তকে ৩৬০ ভাগে ভাগ করা হয়, যার প্রতিটা ভাগ এক ডিগ্রি। এক ডিগ্রির ৬০ ভাগের এক ভাগ হলো এক আর্কমিনিট, আর এক আর্কমিনিটের ৬০ ভাগের এক ভাগ হলো এক আর্কসেকেন্ড। আমাদের টেলিস্কোপের রেজলুশন ১.৭২ আর্কসেকেন্ড, এমেচার হিসেবে খারাপ না। এঙ্গুলার রেজলুশন মিররের সাইজের উপর নির্ভর করে, আর পিক্সেল রেজলুশন নির্ভর করে সেন্সরের উপর, তাই একে সেন্সর রেজলুশন। পিক্সেল রেজলুশন ক্যামেরার মতোই ছবিতে মোট পিক্সেলের সংখ্যা নির্দেশ করে। আমাদের সেন্সরের রেজলুশন ৪.৯ মেগাপিক্সেল, মানে তার বানানো ছবিতে ৪৯ লাখ পিক্সেল থাকে। একটা ছবিতে আকাশের কতটুক এরিয়া কাভার করা হয় তা দেয়া আছে ফিল্ড-অফ-ভিউ হিসেবে, আমাদের ক্ষেত্রে যা প্রায় ৪০ আর্কমিনিট। চাঁদের সাইজ প্রায় আমাদের আঙ্গুলের সমান, প্রায় ৩০ আর্কমিনিট। সুতরাং এই টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদের ছবি তুললে প্রায় পুরা স্ক্রিন জুড়ে আসবে, কারণ প্রায় পুরা ফিল্ড-অফ-ভিউ চাঁদ একাই দখল করে নেবে।
রবি: আর সেন্সিটিভিটি কি জিনিস?
মার্স: একটা টেলিস্কোপ কত অনুজ্জ্বল অব্জেক্ট দেখতে পারে তা বুঝা যায় সেন্সিটিভিটি দিয়ে। এক্ষেত্রে সেন্সিটিভিটি বুঝানো হয়েছে লিমিটিং ম্যাগ্নিচুড দিয়ে, যার মান এখানে ১৮। ব্যাখ্যা করছি। প্রাচীন গ্রিকদের ফলো করে এস্ট্রোনমাররা আকাশের যেকোনো অব্জেক্টের এপারেন্ট ব্রাইটনেস (মানে পৃথিবীর আকাশে আপাত উজ্জ্বলতা) বুঝানোর জন্য একটা লগারিদমিক সিস্টেম বানিয়েছেন। এই সিস্টেমে যে-অব্জেক্টের ব্রাইটনেস যত বেশি তার ম্যাগ্নিচুড তত কম। সূর্যের এপারেন্ট ম্যাগ্নিচুড -২৬, চাঁদের -১৩, উজ্জ্বল তারাদের ০, এবং মানুষ খালি চোখে সর্বোচ্চ ৬ ম্যাগ্নিচুড পর্যন্ত দেখতে পারে। আমাদের টেলিস্কোপের লিমিটিং ম্যাগ্নিচুড ১৮, মানে সে ১৮-র বেশি ম্যাগ্নিচুডের অব্জেক্ট আর দেখতে পারে না। ৬ থেকে ১৮ পর্যন্ত অনেক অব্জেক্টের ছবি আমরা এটা দিয়ে তুলতে পারব যা খালি চোখে কখনো দেখা সম্ভব না।
রবি: তাহলে আকাশের একটা অব্জেক্টের ছবি তুলেই আমরা পার্টিকেল যুগের আলোচনা শেষ করি?
মার্স: নৌকা থেকে খুব ভালো ছবি আসবে না। আজকে বরং আমরা খালি চোখেই আকাশ দেখি। সাংপো নদী দিয়ে আরো কিছু দূর গিয়ে আমরা তীর থেকে ছবি তুলব আরেক দিন।