- English
- বাংলা
Table of Contents
০. ইউনিভার্সের সাত যুগ
[বারজাখের এক সাধারণ রাস্তার ফুটপাতে]
সক্রেটিস: এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, কিন্তু সপ্তম জন কোথায়, ইশ্তার? গতকাল আমি তোমাদের সাত জনের গেস্ট ছিলাম, বিনিময়ে আজকে তোমাদের হওয়ার কথা ছিল আমার গেস্ট।
ইশ্তার: জুনো বরাবরের মতোই লেট।
সক্রেটিস: সাত জনকেই পাওয়া না গেলে তো আমাদের আলাপ ভালো জমবে না।
রবি: শুনেছি জুনো মানস সরোবর ও রাক্ষসতালের মাঝখানে এক বৌদ্ধ বিহারে গেছে সকালে, এখনো ফিরেনি। আমরা বারজাখ ছেড়ে এখন পৃথিবীতে নেমে গেলে কেমন হয়? তুমি তো আমাদেরকে সেখানেই আপ্যায়ণ করতে পারো।
সক্রেটিস: আইডিয়াটা খারাপ না। আর আমি যে আলোচনা দিয়ে তোমাদের আপ্যায়ণ করতে চাই তা মানস সরোবরের তীরেই সবচেয়ে ভালো মানাবে। চলো তাহলে।
[মানস সরোবর ও রাক্ষসতালের মাঝখানে]
সক্রেটিস: কি খবর, জুনো? তোমাকে মিস করতে করতে আমরা আকাশ থেকে একদম পৃথিবীতে এসে পড়লাম।
জুনো: আমি বারজাখে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ লেকের পানিতে মেঘের ছায়া দেখে তোমাদের কথা ভুলে গেছি। জানো তো এখানে মেঘ কত রেয়ার।
সক্রেটিস: মেঘের দিকে আমার বেশি তাকানো ঠিক হবে না। মেঘ না দেখেই এরিস্টোফেনিসের গালি অনেক শুনে ফেলেছি ইতিমধ্যে।
জুনো: আচ্ছা মেঘ দেখতে হবে না। ঐ বিহারের ছাদে চলো, তোমরাও আসো সবাই। ছাদ থেকে একসাথে রাক্ষসতাল, মানস সরোবর ও কৈলাস পর্বত দেখা যায়।
সক্রেটিস: দেখার এত জিনিস থাকলে কি আমার কথার গিফট তোমাদের আর লাগবে?
জুনো: সেটাই তো টেস্ট, সক্রেটিস। গতকাল আমরা একটা আদর্শ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র নিয়ে যে বিশাল আলোচনা তোমাকে উপহার দিয়েছি, তার বিনিময়ে আজকে তোমাকে এমন ভালো কিছু শোনাতে হবে যাতে আমাদের চোখ অন্য কোনোদিকে না ফিরে।
1. সাত যুগ
[মানস সরোবরের তীরে এক বৌদ্ধ বিহারের ছাদে।]
সক্রেটিস: আমি কথা বলব ইউনিভার্সের চৌদ্দ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস নিয়ে। আমাদের উত্তরসূরি ইউরোপিয়ানরা ‘ইউনি’ আর ‘ভার্স’ মিলিয়ে ‘ইউনিভার্স’ শব্দটা বানিয়েছে। ‘ইউনি’ মানে এক, ‘ভার্স’ মানে রূপান্তরিত করা, ‘ইউনিভার্স’ মানে ‘এক জিনিসে রূপান্তরিত করা’। গতকাল তোমরা জাতির কথা বলছিলে, সেই জাতি তৈরির জন্য যে প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে তার নাম ‘ইউনিভার্সিটি’ রাখার কারণ ‘ইউনিভার্সের’ অর্থের মধ্যেই পাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটি যেমন সব স্টুডেন্ট-টিচারকে এক করে একটা জাতির পরিচয় বানায়, ইউনিভার্স শব্দটা তেমন মহাবিশ্বের সবকিছু একটা একক জিনিসের মধ্যে নিয়ে আসে। আমার হাত পা নাক মুখ কান হার্ট সহ অনেক অংশ আছে, কিন্তু সব মিলিয়ে আমি একটা একক মানুষ। তেমনি কসমিক ওয়েবের মধ্যে অনেক গ্যালাক্সি গ্যাস তারা গ্রহ উপগ্রহ গ্রহাণু আছে, কিন্তু সব মিলিয়ে ইউনিভার্স একটা একক জিনিস।
এই ইউনিভার্সের চৌদ্দ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসকে সাত যুগে ভাগ করা যায়: পার্টিকেল, গ্যালাক্টিক, স্টেলার, প্ল্যানেটারি, কেমিকেল, বায়োলজিকেল, ও কালচারাল যুগ। প্রথম তিন লাখ বছর পার্টিকেল যুগ, আর শেষ তিন লাখ বছর কালচারাল যুগ।
রবি: মানস সরোবরের কাছের অনেক গ্লেসিয়ার থেকে যে ব্রহ্মপুত্র নদের জন্ম হয়েছে, তারও কিন্তু সাতটা স্টেজ আছে।
সক্রেটিস: ঠিক। এবং সময়ের সাথে নদীর একটা মেটাফরিকেল সম্পর্কও আছে। কি মনে হয়?
রিয়া: হ্যাঁ, নদীর মতোই আমাদের সময় শুধু এক দিকে যায়।
সক্রেটিস: তাহলে ইউনিভার্সের সময়ের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের তুলনাকে আমরা মেটাফর থেকে এলিগরিতে উন্নীত করতে পারি। ব্রহ্মপুত্রের সাত স্টেজ (আংসি, সাংপো, সিয়াং, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা) হতে পারে ইউনিভার্সের সাত এইজের উপমা। শেকস্পিয়ার মানুষের জীবনের সাতটা এইজের কথা বলেছিলেন বাচ্চাকাল থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত। ইউনিভার্স জন্ম থেকে সাত যুগ পেরিয়ে এখন বেশ বড় হয়েছে। মেঘনার মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র গিয়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে। সাগরের সাথেও কি ইউনিভার্সের সময়ের একটা সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছ?
রিয়া: আংসি থেকে মেঘনা পর্যন্ত সব নদীকে যদি অতীত আর বর্তমানের সাথে তুলনা করা হয়, তবে সাগর তো নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের রূপক।
সক্রেটিস: ঠিক তাই। নদী যেমন অতীতের মতো সরু, সাগর তেমনি ভবিষ্যতের মতো প্রশস্ত। অতীতে আমার জীবনে কেবল এক সেট ঘটনাই ঘটেছে, দুই তীর দিয়ে বাঁধা নদীর মতো। কিন্তু ভবিষ্যতে অনেক কিছু ঘটতে পারে, সমুদ্রের মতোই সেখানে সম্ভাবনা অপার।
রিয়া: অসাধারণ, সক্রেটিস, তোমার সূচনা চমৎকার হয়েছে।
সক্রেটিস: থ্যাংক ইউ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কথা মনে আছে তো: ‘আমি চোখ এই আলোকে মেলব যবে, তোমার ওই চেয়ে দেখা সফল হবে’। তোমরা মনের চোখ না খুললে আমি দেখতে পারব না। মহাবিশ্বের প্রত্যেক যুগের সাথে ব্রহ্মপুত্রের প্রত্যেক স্টেজের সম্পর্কটা দেখানোর দায়িত্ব প্রথমে তোমাদের নিতে হবে। তারপর আমি আগামী সাত দিনে প্রত্যেক যুগ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলব।
রিয়া: আমরা রাজি। কে কোনটা বলব?
সক্রেটিস: তা তো বুঝতেই পারছ। তোমাদের নামগুলি কাকতালীয়ভাবে সপ্তাহের সাত দিনের সাথে, বা আমাদের আমলের সাত প্ল্যানেটের সাথে মিলে গেছে। রবির সাথে রবিবার ও সূর্য, লুনার সাথে সোমবার ও চাঁদ, মার্সের সাথে মঙ্গলবার; হার্মিস মার্কারির আরেক নাম হওয়াতে বুধবারের সাথে যায়, জুনো জুপিটারের কনসর্ট হিসেবে বৃহস্পতিবারের সাথে মিলে, ইশ্তার ভেনাসের পূর্বসূরি হিসেবে শুক্রের সাথে যায়, আর রিয়া স্যাটার্নের কনসর্ট হিসেবে শনিবারের সাথে সম্পর্কিত। রবি শুরু করবে পার্টিকেল যুগের সাথে আংসির তুলনা দিয়ে, তার পর একে একে সবাই, আর রিয়া শেষ করবে কালচারাল যুগের সাথে মেঘনার তুলনা দিয়ে। রবি, শুরু করো।
2. সাত যুগ, সাত নদী
রবি: পার্টিকেল যুগ যদি মহাবিশ্বের ইতিহাসের প্রথম তিন লাখ বছর হয়ে থাকে তাহলে তার সাথে আংসি নদীর মিল পাওয়া খুব সহজ। পার্টিকেল যুগ এমন একটা সময় যা মানুষ এখন পর্যন্ত সরাসরি অব্জার্ভ করতে পারেনি। আংসির উৎস খুঁজে পাওয়া যেমন কঠিন, ইউনিভার্সের উৎস বের করাও তেমন কঠিন। আংসি নদী দিয়ে রূপকের সাথে বিজ্ঞানের একটা বিরোধও পরিষ্কার করা যায়। ব্রহ্মপুত্রের প্রথম স্টেজ আসলে শুধু আংসি না, আরো অনেকগুলো নদীই এক স্রোতে মিলে এক পর্যায়ে সাংপো বানায়। তুমি শুধু আংসি নিয়েছ হয়ত মোট সংখ্যা সাতে রাখার জন্য, অথবা নামটা শুনতে ছোট ও সুন্দর বলে। কবিতায় ব্রেভিটি, বিউটি, মেটাফর, সিমিলি, এলিগরি এই সব যেভাবে কাজ করে, বিজ্ঞানেও সেরকম করতে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে।
সক্রেটিস: একদম ঠিক বলেছ, রবি। মেটাফর আমরা ইউজ করব যেভাবে শেকস্পিয়ার করতেন। তিনি যখন জুলিয়েটকে সূর্য বলেন তখন জুলিয়েট যে আসলেই একটা জ্বলন্ত গ্যাসের গোলক হয়ে যায় না সেটা সব সময় মাথায় রাখতে হবে। শশী, এবার তোমার পালা।
শশী: সাংপোর সাথে গ্যালাক্টিক যুগের মিল আরো স্বাভাবিকভাবে করা যায়। গ্যালাক্সির মধ্যে যে বিশালতার ফিলিং আছে সাংপোর দুই তীরে তিব্বতের শুভ্রতা দেখলেও তেমন ফিলিং হতে পারে। গ্যালাক্সিও ও তাদের ক্লাস্টার ইউনিভার্সের সবচেয়ে বড় স্ট্রাকচার, সাংপোও ব্রহ্মপুত্রের সবচেয়ে লম্বা অংশ। এর চেয়ে বেশি মিল বানাতে চাইলে মানুষ আমাদেরকে মৌলবাদী ডাকা শুরু করবে।
সক্রেটিস: এই টুকুই যথেষ্ট। চাঁদের সাথে তুলনাও বেশিক্ষণ শুনতে ভালো লাগে না। মার্স, এখন তোমার যুদ্ধ শুরু করো।
মার্স: অরুণাচলের সিয়াং আসলেই এক বিরাট যুদ্ধক্ষেত্র, স্টেলার যুগে গ্যাস-ডাস্টের বিশাল মেঘ থেকে গ্রহ-তারার জন্মের মতোই ভায়োলেন্ট। ইয়ার্লুং-সাংপো ক্যানিয়ন (গর্জ) পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর গিরিখাত, ছয় কিলোমিটার গভীর। সিয়াং নদী লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হিমালয় কেটে এই গর্জ বানিয়েছে বঙ্গোপসাগরের প্রেমে। এই গভীর গর্জের (গিরিখাত) গর্জনের শব্দ যে শোনেনি, তাকে সেটা শুধু ভাষার শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব না। একটা ঘুরন্ত গ্যাসমেঘ থেকে কিভাবে একটা সোলার সিস্টেমের জন্ম হয় সেই ভয়ানক ভায়োলেন্ট ও ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্যও কোনো জীবন্ত মানুষের পক্ষে স্বচক্ষে দেখা সম্ভব না।
সক্রেটিস: পারফেক্ট। হার্মিস, কি ভাবছ মানসের দিকে তাকিয়ে?
হার্মিস: পাহাড় কেটে সিয়াং যখন আসামের সমতলে নামে তখন নদীর চরিত্রে হঠাৎ যে বিশাল পরিবর্তন আসে তাই ভাবছিলাম। এই পরিবর্তনের সাথে সহজেই প্ল্যানেটারি যুগের প্রথম এক দুই বিলিয়ন বছরের তুলনা চলতে পারে। জন্মের পর পর পৃথিবী আগুনের মতো গরম ছিল, তার উপর চলছিল স্পেস থেকে আসা হাজার হাজার পাথরের বম্বার্ডমেন্ট। কোটি কোটি বছরের এই যুদ্ধাবস্থা শেষে যখন পৃথিবীর সার্ফেসে সমুদ্রের অভ্যুত্থান ঘটে, তখন সাগরের ভিতরে তৈরি হয় ভালোবাসার বাসা, মানে জীব তৈরির কারখানা। অরুণাচলের সিয়াং যদি হয় যুদ্ধের ময়দান, আসামের ব্রহ্মপুত্র তাহলে শান্তির উদ্যান।
সক্রেটিস: এত সুন্দর তুলনা আমার মাথায় আগে আসেনি। জুনো, এবার তোমার পালা।
জুনো: ব্রহ্মপুত্র আসাম থেকে বাংলাদেশে ঢোকার পর হয়ে যায় যমুনা। এই যমুনার সাথে ভারতের ইয়ামুনার কোনো সম্পর্ক নাই। তবু যমুনা শব্দটা শুনলেই যেহেতু রাধা-কৃষ্ণের প্রেম আর আগ্রায় ইয়ামুনার তীরে তাজমহলের কথা মাথায় আসে, সেহেতু যমুনা নদীর সাথে কেমিকেল যুগের তুলনা খুব স্বাভাবিক। প্ল্যানেটারি যুগে সমুদ্রের তলায় তৈরি হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট যদি হয় ভালোবাসার বাসা, তাহলে কেমিকেল যুগে এই বাসায় প্রথম এমন জীবের জন্ম হয়েছে যারা যুগলবন্দি হয়ে বংশের ধারা তৈরি করতে পারে। এই মিলনের সাথে সুন্দরভাবে তুলনা করা যায় ঢাকার কাছে রাজবাড়ীতে যমুনার সাথে পদ্মার (গঙ্গা) মিলনের।
সক্রেটিস: এই মিলন আসলেই ইন্টারেস্টিং। ভেবে দেখো, গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র মানস সরোবরের কাছে প্রায় একই জায়গা থেকে জন্ম নেয়, ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের উত্তর ঢাল থেকে, গঙ্গা দক্ষিণ ঢাল থেকে। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মা ও যমুনা নাম নিয়ে দুই জন এমন এক জায়গায় মিলিত হয় যার নাম রাজবাড়ী। যমুনা যদি হয় কেমিস্ট্রির প্রতীক, গঙ্গা হতে পারে কালচারের প্রতীক, যেহেতু গঙ্গার তীরেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন রাষ্ট্রীয় কালচারের একটা বেড়ে উঠেছে। আচ্ছা, ইশ্তার মনে হয় অধৈর্য হচ্ছে, শুরু করো।
ইশ্তার: এটা খুবই সিম্বলিক যে বায়োলজিকেল যুগ এমন এক জায়গা থেকে শুরু হচ্ছে যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই নদী মিলিত হয়। রাজবাড়ী থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মা নামে যা প্রবাহিত হয় তা আসলে দুইটা বড় নদীর (যমুনা নামে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা নামে গঙ্গা) মিলনের ফল। স্রোতের দিক দিয়ে পদ্মা যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে বৈপ্লবিক নদীর একটা সেহেতু এর সাথে বায়োলজিকেল যুগের তুলনা মানানসই। কারণ এই যুগে লক্ষ কোটি প্রজাতির উদ্ভিদ প্রাণী ফাঙ্গাস ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে একটা প্ল্যানেট ভরে যাওয়া ইউনিভার্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব।
সক্রেটিস: নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড়। রিয়া, তোমার দায়িত্ব এখন শেষ করা।
রিয়া: আমার কিন্তু মনে হয় জীবের চেয়ে বড় বিপ্লব ছিল সংস্কৃতি, আর কালচারাল যুগের সাথে মেঘনার তুলনা সবচেয়ে স্বাভাবিক। শুরুতে মহাবিশ্ব একটা একক অবিচ্ছিন্ন গ্যাসের মতো ছিল, এই গ্যাস খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ধীরে ধীরে আলাদা আলাদা অনেক কিছু তৈরি করেছে, কিন্তু এই সব সৃষ্টি আবার অন্য সৃষ্টির সাথে সব সময় মিলতে চেয়েছে। কালচার হচ্ছে আলাদা আলাদা জিনিসকে একত্রিত করার সবচেয়ে ভালো উপায়। মেঘনা নদীও এই কাজটাই করে। বাংলাদেশের অনেক নদী মেঘনায় এসে পড়ে, আর মেঘনা সবাইকে নিয়ে একসাথে ছুটে যায় বঙ্গোপসাগরের দিকে, ঠিক যেমন কালচার অনেক মানুষকে একসাথে নিয়ে ছুটে যেতে চায় ভবিষ্যতের দিকে, অন্তরে অনেক স্বপ্ন নিয়ে।
3. স্থান-কাল-শক্তি-বস্তু
সক্রেটিস: অসাধারণ উপসংহার, রিয়া। সময়ের অস্তিত্ব যেহেতু এসেই পড়ল, আমার মনে হয় এটা নিয়েই আমাদের আরেকটু চিন্তা করা উচিত।
রিয়া: হ্যাঁ, এবং মেটাফর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের একটু রিয়েল বিজ্ঞানেও মনোযোগ দেয়া উচিত।
সক্রেটিস: কেন নয়? ইউনিভার্সের কিছু গাণিতিক নিয়ম আছে যাদের আল্টিমেট উৎস মানুষ জানে না। তাছাড়া আমরা মৃতরাও তা এখন পর্যন্ত জানি না। কিন্তু এসব নিয়ম যেসব জিনিসের উপর কাজ করে সেগুলো আমাদের চেনা। ইউনিভার্সে নিয়ম মেনে চলা যা-কিছু আছে তাদেরকে স্পেস, টাইম, এনার্জি, ম্যাটার (সংক্ষেপে ‘স্টেম’) এই চার ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। আইনস্টাইন বিশ শতকের শুরুতে এই চার জিনিস নিয়েই কাজ করেছিলেন। তার স্পেশাল রেলেটিভিটি বলে, স্পেস ও টাইম একই জিনিস, এবং এনার্জি ও ম্যাটার একই জিনিস। জেনারেল রেলেটিভিটি (জিআর) স্পেসটাইম ও এনার্জি-ম্যাটারের মধ্যে মৌলিক সম্পর্কটা জানায়। এই সুপারস্ট্রাকচারের গাণিতিক ভিত্তি আমি বুঝি না, যদিও তা বুঝা আমার ভবিষ্যৎ অনন্ত জীবনের একটা বড় কাজ।
রবি: কিন্তু এই গাণিতিক ভিত্তি না বুঝলে কি এটা নিয়ে আলোচনা করে কোনো লাভ আছে? আমি মরার আগ পর্যন্ত রেলেটিভিটি নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করে যা বুঝেছি তা হলো, ম্যাথ না জানলে মানুষ এটা নব্বই পার্সেন্ট ভুল বুঝে।
সক্রেটিস: কেন নব্বই, আমি বলব নাইন্টি-নাইন পার্সেন্ট ভুল আমি নিজেও করি। আমার একমাত্র জ্ঞান হলো আমি কিছু জানি না।
রবি: তাহলে তোমার কথার গিফটে তো আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি।
সক্রেটিস: আরে আমার কথায় তরুণদের ক্ষতি হয়েছিল বলেই তো আমাকে হেমলক পান করে মরতে হলো। তাই এখন কারো ক্ষতি করতে ভয় পাই না। তবে যদি তুমি সত্যিই চাও কারো ক্ষতি না হোক, তাহলে নিজেই আমাদেরকে প্লিজ বলো ইউনিভার্সের স্পেসটাইম চিন্তা করার সবচেয়ে ভালো উপায় কি।
রবি: বাংলায় বা ইংলিশে যা বলব তাই ভুল হতে বাধ্য, শুধু ম্যাথই ঠিকটা বলতে পারে। তোমরা যেহেতু স্পেসটাইমের ম্যাথ বুঝতে অক্ষম, তাহলে নিরানব্বই পার্সেন্ট ভুল ভার্সনটাই শোনো। আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে জিআর আবিষ্কার পরে মনে করেছিলেন, বিপুল পরিমাণ এনার্জি-ম্যাটার থাকার কারণে ইউনিভার্সের স্পেসটাইম অনেক বাঁকা হবে। পদার্থ যত বেশি থাকে, স্থান তত বেশি বাঁকে। এই চারমাত্রিক কার্ভেচারের গাণিতিক মডেলও তিনি বানিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ তো দূরের কথা, আমাদের পক্ষেও এই মডেলের চতুর্মাত্রিক বক্স ভিজুয়ালাইজ করা অসম্ভব। কিন্তু স্পেসের তিনটা মাত্রাকে যদি দুই মাত্রায় রিডিউস করি, স্থানকালের একটা ত্রিমাত্রিক মডেল চোখের সামনে একদম পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি ট্যাব্লেটে আঁকলে বুঝতে পারবে। এই দেখো:
আইনস্টাইনের কার্ভবল নামে পরিচিত এই স্ফিয়ারের সার্ফেস হলো দুই মাত্রার স্পেস, আর রেডিয়াস বরাবর আছে টাইম। এই মডেলে ইউনিভার্সের সব এনার্জি-ম্যাটার একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা নির্দিষ্ট রেডিয়াসের স্ফিয়ারের কেবল সার্ফেসে থাকে। সময়ের সাথে রেডিয়াস বাড়ে, এবং ইউনিভার্সের সাইজও বাড়ে সার্ফেস এরিয়ার সাথে। আইনস্টাইন প্রথমে রেডিয়াস বাড়ার কথা ভাবেননি, তিনি এরিস্টটলের মতো সুস্থির মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। রেডিয়াস যাতে না পাল্টায় সেজন্য কসমোলজিকেল কনস্টেন্ট নামে একটা কনস্টেন্টও তার ইকুয়েশনে যোগ করেছিলেন। কিন্তু পরে ১৯৩০ সালের দিকে মহাবিশ্বের প্রসারণের প্রমাণ পাওয়ার পর কনস্টেন্টটা সরিয়ে নেন। একুশ শতকে মানুষ এই কনস্টেন্ট আবার ফিরিয়ে এনেছে রেডিয়াস থামানোর জন্য না, বরং রেডিয়াস বাড়ার স্পিড নিয়ন্ত্রণের জন্য।
বর্তমানে আমরা জানি ইউনিভার্স সব দিকে একই রকম এবং সব জায়গায় তার ডেন্সিটিও গড়ে সমান। এটাও এই ত্রিমাত্রিক স্পেসটাইমের গোলক দিয়ে বুঝা যায়। গোলকের সার্ফেসটাকে পৃথিবীর সার্ফেস ভাবো, আর ভাবো তুমি প্যাসিফিকের এমন জায়গায় এক ভেলায় ভাসছ যেখান থেকে যেদিকে তাকাও শুধু পানি আর পানি, সব দিক একই রকম, এবং যেদিকেই যাও সবখানে পানির ঘনত্বও একই।
সক্রেটিস: কিন্তু, রবি, উপরের দিকে তাকালে তো আর এক রকম দেখব না।
রবি: আরে, সক্রেটিস, তুমি এখনো আগের মতোই একগুঁয়ে। স্পেসের তিন মাত্রা যদি আমরা শুরুতেই দুই মাত্রায় নামিয়ে আনি, তাহলে প্যাসিফিকের সার্ফেস ছাড়া কি আর স্পেস বলে কিছু থাকতে পারে?
সক্রেটিস: না।
রবি: আর এই সার্ফেস ছাড়া যদি স্পেসই না থাকে, তুমি উপরের দিকে তাকাবে কিভাবে? উপরে তাকাতে হলে তো আবার তিন মাত্রার স্পেস লাগবে যা আমরা এই মডেলের খাতিরে দুই মাত্রায় নামিয়ে এনেছি ইতিমধ্যে।
সক্রেটিস: আচ্ছা, বুঝলাম।
রবি: ইউনিভার্স সব দিকে একই রকম লাগার ব্যাপারটাকে কসমোলজিকেল প্রিন্সিপল বলে। ত্রিমাত্রিক এই মডেল ইউজ করে আমাদের ইউনিভার্সের আরো দুইটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমটা এই রকম। হাবল দেখতে পেয়েছিলেন, দূরের সব গ্যালাক্সি আমাদের থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে, এবং যে যত দূরে তার দূরে সরার বেগও তত বেশি। আসলে গ্যালাক্সিরা সরছে না, স্পেসটাইম প্রসারিত হচ্ছে। উপরের স্ফিয়ারটাকে যদি একটা বেলুন হিসাবে চিন্তা করি, আর প্রতিটা গ্যালাক্সি যদি এই বেলুনের উপরে একেকটা দাগ হয়, তাহলে বেলুন যত বড় হবে রেডিয়াস বা টাইম তত বাড়বে, সেই সাথে বেলুনের সার্ফেস এরিয়া বাড়বে এবং দাগগুলো (গ্যালাক্সি) একে অপরের থেকে দূরে সরতে থাকবে। প্রত্যেক দাগ মনে করবে বাকি সব দাগ তার থেকে দূরে সরছে, প্রত্যেকের মনে হবে সে-ই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে, যেহেতু সবকিছু তার থেকে সরছে। কিন্তু আসলে কেউই কেন্দ্র না। একটা স্ফিয়ারের সার্ফেসের কোনো কেন্দ্র থাকে না, কিন্তু সার্ফেসের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে নিজেকে সবকিছুর কেন্দ্রে মনে হয়।
সক্রেটিস: চমৎকার। আর দ্বিতীয়টা কি?
রবি: দ্বিতীয়টা এই রকম। আমরা পৃথিবী থেকে যেদিকেই আমাদের টেলিস্কোপ তাক করি না কেন সব দিকে সমান দূরত্ব পর্যন্ত দেখতে পাব। আইনস্টাইনের স্পেশাল রেলেটিভিটি অনুযায়ী আলোর বেগ কনস্টেন্ট হওয়াতে, আমাদের হরাইজন স্পেস ও টাইম দুই দিকেই সীমাবদ্ধ। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরা যাক আমাদের তিনটা টেলিস্কোপ আছে, তাদের নাম এক্স, ওয়াই, জেড, এবং ধরা যাক সব গ্যালাক্সির এবসলুট বা আসল ব্রাইটনেস একই রকম। তাহলে যে টেলিস্কোপ যত সেন্সিটিভ সে তত দূরের গ্যালাক্সি দেখতে পাবে। এখন ধরি এক্স সর্বোচ্চ ১ বিলিয়ন লাইটিয়ার দূরের গ্যালাক্সি দেখতে পারে, ওয়াই দেখতে পারে ২ বিলিয়ন লাইটিয়ার দূর পর্যন্ত, আর জেড ৩ বিলিয়ন লাইটিয়ার পর্যন্ত। তাহলে এক্সের অব্জার্ভ করা ইউনিভার্স এক বিলিয়ন লাইটিয়ার রেডিয়াসের একটা বেলুন, ওয়াইয়ের বেলুনের রেডিয়াস দুই বিলিয়ন লাইটিয়ার, আর জেডের দেখা মহাবিশ্বের রেডিয়াস ৩ বিলিয়ন লাইটিয়ার।
সক্রেটিস: কিন্তু এর সাথে আমাদের ত্রিমাত্রিক স্পেসটাইম বেলুন তো মিলছে না। ছবির বেলুনে রেডিয়াস ছিল টাইম, তোমার তিন টেলিস্কোপের অব্জার্ভেবল ইউনিভার্সে রেডিয়াস হলো স্পেস, কারণ তার ইউনিট লাইট ইয়ার।
রবি: এখানেই তো চিন্তা করতে হবে। লাইট ইয়ার ডিস্টেন্সের ইউনিট হলেও এটা সময়ের সাথে সম্পর্কিত। এক বিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরের গ্যালাক্সি দেখছি মানে সেটা এক বিলিয়ন বছর আগে কেমন ছিল তা দেখছি, কারণ সেখান থেকে আলো আসতে এক বিলিয়ন বছর লেগেছে। আলো সেকেন্ডে তিন লাখ কিমি স্পিডে এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাই এক লাইট ইয়ার, বা প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন কিমি। সুতরাং অব্জার্ভেবল ইউনিভার্সের বেলুনেও রেডিয়াস আসলে টাইম। এক্সের বেলুনের রেডিয়াস এক বিলিয়ন বছর, কারণ সে এক বিলিয়ন বছর অতীত পর্যন্ত দেখতে পারে।
সক্রেটিস: এখানে আমার দুইটা অব্জার্ভেশন আছে। প্রথমত আইনস্টাইনের কার্ভবলের যে ছবি দেখালে সেটাও কি এক ধরনের মেটাফর না?
রবি: ভালো পয়েন্ট। এটা ঠিক যে কার্ভবল ইউনিভার্সের বাস্তব ছবি না। আমাদের বিশ্ব চারমাত্রিক, এটাকে তিন মাত্রায় নামানো গাণিতিক দিক দিয়ে ট্রিভিয়াল হলেও মানসিক দিক দিয়ে অলীক। কিন্তু কার্ভবলকে তবু মেটাফর বলা চলে না, এর স্থান মেটাফরের উপরে, হয়ত এনালজি বলা যায়।
সক্রেটিস: আচ্ছা মানলাম। অন্য অব্জার্ভেশনটা এই রকম। তোমার অব্জার্ভেবল ইউনিভার্সের ম্যাপ দেখে আমার মনে হচ্ছে নিজেকে কখনো দেখা যায় না, বর্তমান দেখা যায় না, দেখা যায় শুধু অন্যকে, দেখা যায় শুধু অতীত। নিজেকে যদি দেখাই না যায়, নিজেকে জানা কি সম্ভব? আমার কথা নিয়েই আমার সন্দেহ হচ্ছে এখন।
রবি: অতীত দেখে যদি আমরা বর্তমান সম্পর্কে জানতে পারি, অন্যকে দেখে দেখার মাধ্যমে কি নিজেকে জানতে পারব না?
4. টাইমলাইন
সক্রেটিস: অতীতের টাইমলাইন আছে বলেই আমরা ইউনিভার্সের বর্তমান ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। সমাজের ক্ষেত্রেও অতীত ছাড়া বর্তমান বুঝা সম্ভব না। মানুষের ক্ষেত্রে অন্যকে দেখে নিজেকে জানা সম্ভব কি না তা নিয়ে অবশ্য আমার ডাউট আছে। তবে সে যাই হোক, আমার মনে হয় এই সুযোগে তোমাদেরকে আমার বানানো টাইমলাইনটা দেখিয়ে ফেলতে পারি।
এই টাইমলাইনে ইউনিভার্সের প্রতি যুগ থেকে সাতটা করে ইভেন্ট রাখা হয়েছে। তাহলে মোট ইভেন্ট আছে ৪৯টা। প্রতি ইভেন্টের জন্য একটা করে স্লাইড রাখা হয়েছে, আর স্লাইডের নিচে আছে একটা নেভিগেশন, যা জুম ইন ও আউট করা যায় এবং ডানে বামে প্যান করা যায়। আমাদের মেডিটেশনের জন্য এটা কাজে লাগবে। টাইমলাইন ব্রাউজ করা হতে পারে একটা চিকন দড়ির উপর দিয়ে ইউনিভার্সের ইতিহাসের দিকে হেঁটে যাওয়ার একটা ধ্যান। আমার মনে হয় রবি থেকে শুরু করে আবার সবাই যদি যার যার যুগের সাতটা ইভেন্ট দেখে কিছু মন্তব্য করো, তাহলে আমাদের সবার জন্যই ভালো হবে। রবি?
রবি: হ্যাঁ, অবশ্যই। শুরুতে আমাকে আবারো বলতেই হবে, ম্যাথ ছাড়া এইভাবে ইতিহাস চর্চা আমার জন্য সম্মানজনক না। তবু পড়ছি। পার্টিকেল যুগের প্রথম ইভেন্ট অবশ্যই বিগব্যাং, যার মাধ্যমে আনুমানিক চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের ইউনিভার্সের জন্ম হয়েছে। জন্মের পর থেকে ইউনিভার্স প্রসারিত হচ্ছে, কখনো জোরে, কখনো আস্তে। বিগব্যাঙের সাথেসাথেই ইনফ্লেশন নামে একটা ঘটনায় ইউনিভার্স হঠাৎ করে অনেক প্রসারিত হয়েছিল। এর পর এক সেকেন্ডের এক ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগের মধ্যে সব ফোর্সের জন্ম হয়েছে। প্রথম সেকেন্ডের মধ্যে এসেছে সব এলিমেন্টারি পার্টিকেল, কোয়ার্ক, ইলেক্ট্রন, প্রোটন, ইত্যাদি। প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে একাধিক প্রোটন জড়ো হয়ে হিলিয়ামের মতো এলিমেন্টের নিউক্লিয়াস তৈরি হয়েছে। প্রথমে ম্যাটারের চেয়ে এনার্জির ঘনত্ব বেশি ছিল। বিগব্যাঙের পঞ্চাশ হাজার বছর পর এনার্জিকে হারিয়ে ম্যাটারের ডেন্সিটি বেড়ে যায়। আর তিন লাখ বছরের মাথায় প্রোটনের নিউক্লিয়াসের সাথে ইলেক্ট্রন মিলে এটম তৈরি করে, এবং ফোটনরা ফ্রি ইলেক্ট্রনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়। এই সব ফ্রি ফোটন আমরা এখনো অব্জার্ভ করতে পারি মাইক্রোওয়েভ হিসেবে। এদের মাধ্যমেই আমরা তৈরি করেছি ইউনিভার্সের প্রথম ছবি। এখানেই পার্টিকেল যুগ শেষ। শশী?
শশী: টাইমলাইনে গ্যালাক্টিক যুগের সাতটা ইভেন্ট দেখলাম। কাহিনিটা এই রকম। পার্টিকেল যুগের শেষে ইউনিভার্স মানে ছিল একটা একক গ্যাস, যার সব জায়গায় ডেন্সিটি প্রায় সমান, তবে কিছুটা ভেরিয়েশন আছে। যেখানে ডেন্সিটি একটু বেশি, ডার্ক এইজে সেই সব জায়গা ডার্ক ম্যাটারের প্রভাবে আরো ডেন্স হতে থাকে। বিগব্যাঙের একশ মিলিয়ন বছর পর ডার্ক এইজ শেষ হয়, আরো দুইশ মিলিয়ন বছর পর ওভারডেন্সিটির জায়গাগুলিতে গ্যাসের জমায়েত থেকে গ্যালাক্সি ও তারার জন্ম শুরু হয়; এর নাম কসমিক ডন। প্রথম ছয়শ মিলিয়ন বছরের মধ্যে ইন্টারগ্যালাক্টিক মিডিয়াম তৈরি হয়, আর আটশ মিলিয়ন বছরের মধ্যে জন্মায় আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে। বিগব্যাঙের এক বিলিয়ন বছর পর ইউনিভার্স গ্যালাক্সিতে ভরে যায় এবং আড়াই বিলিয়ন বছরের মধ্যেই কোয়েজার অর্থাৎ সবচেয়ে ম্যাসিভ ও এক্টিভ গ্যালাক্সিদের জন্ম হয়। বিগব্যাঙের তিন বিলিয়ন বছর পর গ্যালাক্সিদের ক্লাস্টার যখন ফর্ম করে তখনি গ্যালাক্টিক যুগ শেষ। মার্স?
মার্স: স্টেলার যুগের শুরু ধরা হয়েছে ১০.৪ বিলিয়ন বছর আগে, মানে বিগব্যাঙের সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর পর। তখন ইউনিভার্সের গ্যালাক্সিদের ভিতরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে তারা তৈরি হচ্ছিল। আজ থেকে দশ বিলিয়ন বছর আগে পপুলেশন একের তারাদের জন্ম, যারা তরুণ, মেটাল-রিচ, এবং গ্যালাক্সির ডিস্কে থাকে। নয় বিলিয়ন বছর আগে তারাদের অনেক ক্লাস্টার তৈরি হয় এবং আমাদের গ্যালাক্সি তার থিন ডিস্ক পায়। এর এক বিলিয়ন বছর পর গ্যালাক্সিদের সুপারক্লাস্টার গঠনের কারণে মহাবিশ্বে অনেক ভয়েড তৈরি হয়। ছয় বিলিয়ন বছর আগে এট্রাক্টিভ গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধে রিপালসিভ ডার্ক এনার্জির জয় হয়, এই কারণে ইউনিভার্সের প্রসারণের স্পিড বাড়তে শুরু করে। সাড়ে পাঁচশ কোটি বছর আগে মিল্কিওয়ে স্পাইরাল শেইপ পায়, আর ৪৬০ কোটি বছর আগে আমাদের সোলার সিস্টেমের জন্মের মাধ্যমে শেষ হয় স্টেলার যুগ। হার্মিস?
হার্মিস: প্ল্যানেটারি যুগের প্রথম ইম্পর্টেন্ট ঘটনা সাড়ে ৪৫৫ কোটি বছর আগে ইনার (সূর্যের কাছের) প্ল্যানেটদের জন্ম। এর পাঁচ কোটি বছর পর সূর্য মেইন সিকোয়েন্স, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ তারার মর্যাদা পায়। আনুমানিক ৪৪০ কোটি বছর আগে গরম পৃথিবী ঠাণ্ডা হয় এবং সমুদ্রের জন্ম হয়। কিন্তু তার পর প্রায় ত্রিশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর উপর চলে স্পেস থেকে আসা পাথরের বিশাল বম্বার্ডমেন্ট। এই দুর্যোগের শেষেই গঠিত হয় কন্টিনেন্টাল ক্রাস্ট যারা এখনো নড়ছে, এখনো মহাদেশের রূপ পাল্টাচ্ছে। আজ থেকে ৩৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সব মহাদেশ একসাথে যুক্ত হয়ে তৈরি করেছিল ভালবারা সুপারকন্টিনেন্ট। এখানেই এই যুগ শেষ। জুনো?
জুনো: সক্রেটিস, তুমি কেমিকেল যুগ শুরু করেছ ৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে, যখন সমুদ্রের তলায় হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের মধ্যে সম্ভবত প্রথম জড় পদার্থ থেকে জৈব প্রাণ তৈরি হয়েছিল। জীবের প্রথম ফসিল পাওয়া যায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগের। প্রথম সফল জীব ব্যাক্টেরিয়া সাগর ছেড়ে মাটিতে এসেছিল প্রায় তিন বিলিয়ন বছর আগে। তার একশ মিলিয়ন বছর পর থেকে সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ সায়ানোব্যাক্টেরিয়া ফটোসিন্থেসিসের মাধ্যমে পৃথিবীর এটমস্ফিয়ারে অক্সিজেন ছাড়তে শুরু করে। কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াস বানিয়ে প্রথম ইউক্যারিয়ট আসে ২.৭ বিলিয়ন বছর আগে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক বাড়ে আড়াই বিলিয়ন বছর আগে, যার তিনশ মিলিয়ন বছর পর ওজোন লেয়ার তৈরি হয়। ওজোন দিয়েই শেষ হয় কেমিকেল যুগ। ইশ্তার?
ইশ্তার: বায়োলজিকেল যুগে জীবের বৈচিত্র্য বাড়তে শুরু করে। দেড় বিলিয়ন বছর আগে প্রথম জটিল কোষ তৈরি হয়। অনেক কোষ একসাথে হয়ে বহুকোষী জীবের বিপ্লব আনে ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে। তার দুইশ মিলিয়ন বছর পর পানি থেকে জমিনে উঠে আসে প্রাণীরা। দুইশ মিলিয়ন বছর আগে গরম রক্তের প্রাণীদের জন্ম, আর ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে এস্টারয়েডের আঘাতে ডাইনসোরদের বিলুপ্তির মাধ্যমে শেষ হয় এই যুগ। রিয়া?
রিয়া: আনুমানিক ৭ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম হোমিনাইনদের জন্মের মাধ্যমে শুরু হয়েছে কালচারাল যুগ। অস্ট্রালোপিথেকাস ও হোমো জেনাসের প্রাণীরা পৃথিবীতে এসেছে ৪ থেকে ১ মিলিয়ন বছর আগে। আর প্রথম আধুনিক মানুষ পৃথিবীতে হেঁটেছে সম্ভবত তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকায়। আফ্রিকা থেকে মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এক লাখ বছর আগে। পঞ্চাশ হাজার বছর আগে ধর্ম, মিউজিক ও আর্টে এক বিশাল বিপ্লব শুরু করে মানুষরা। কৃষিকাজ শুরু হয় দশ হাজার বছর আগে, যার পাঁচ হাজার বছর পর আসে প্রথম রাষ্ট্র। পাঁচশ বছর আগে শুরু হয় গ্লোবালাইজেশন, যার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে দুইশ বছর আগে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলুশনের মাধ্যমে। এখানেই শেষ কালচারাল যুগ।
সক্রেটিস: প্রত্যেকের মুখে শোনা আসলেই খুব দরকার ছিল। বুঝতেই পারছ, আমি ইউনিভার্সের সব জায়গার ইতিহাস বলছি না, বলছি আসলে মানুষের ইতিহাস। ইউনিভার্স এখানে মানুষের ইতিহাসের অংশ হিসেবে এসেছে। এই কারণেই গ্যালাক্টিক যুগে মিল্কিওয়ের কথা বলা হয়েছে, স্টেলার যুগে প্রধানত মিল্কিওয়ের তারাদের উপর ফোকাস করা হয়েছে, প্ল্যানেটারি যুগের মূল বিষয় সোলার সিস্টেম, আর কেমিকেল ও বায়োলজিকেল যুগের বিষয় পৃথিবীর বায়োস্ফিয়ার, আর কালচারাল যুগের বিষয় শুধু মানুষের কালচার। এটা আমাদের ইতিহাস, আমাদের ধ্যানের বিষয়।