ওয়েবের দেখা গ্যালাক্সি ফায়ারফ্লাই স্পার্কল যেন এক ঝাঁক জোনাকি
প্রথমবারের মতো নাসা’র জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (ওয়েব) ৬০ কোটি বছর বয়সি মহাবিশ্বের এমন একটি গ্যালাক্সি আবিষ্কার ও ওজন করেছে যার ভর আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের জন্মের সময়কার ভরের প্রায় সমান, মানে আনুমানিক ২ কোটি সূর্যের ভরের সমান (বর্তমানে মিল্কিওয়ের ভর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন সূর্যের সমান)। ওয়েব দুরবিন একই সময়ের অন্য যেসব গ্যালাক্সি আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছে তাদের ভর আরো অনেক বেশি ছিল। ফায়ারফ্লাই স্পার্কল নামে পরিচিত এই নবীন গ্যালাক্সিতে দশটি উজ্জ্বল স্টার ক্লাস্টার (তারাপুঞ্জ) আছে, প্রতিটার ভর প্রায় ১ মিলিয়ন সূর্যের সমান, এবং প্রত্যেকটিই গবেষকরা গভীরভাবে পরীক্ষা করেছেন।
“আমি ভাবতে পারিনি মহাবিশ্বের এত আগের একটি গ্যালাক্সিকে এতগুলো আলাদা অংশে ভাগ করে দেখা সম্ভব হবে, তার উপর এমন একটা গ্যালাক্সি যার ভর আমাদের গ্যালাক্সির জন্মের সময়কার ভরের সমান,” বললেন এই আবিষ্কারের পেপারের কো-লিড লামীয়া আশরাফ মওলা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলসলি কলেজে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) সেন্টার ফর এস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্স এন্ড এস্ট্রোফিজিক্সের (সিএএসএসএ, কাসা) এসোসিয়েট মেম্বার। তিনি আরো বলেন, “এত ছোট একটি গ্যালাক্সির ভিতরে ঘটছে অনেক কিছু, এর মধ্যে চলছে বিভিন্ন দশার অনেকগুলো তারার গঠন প্রক্রিয়া।”
ওয়েব এই গ্যালাক্সির এত ভালো ছবি তুলতে পেরেছে দুটি কারণে। একটা কারণের জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে মহাবিশ্বকে: আমাদের তুলনামূলক কাছে পুরোভূমির একটি অনেক ভারী গ্যালাক্সি ক্লাস্টার (হাজার গ্যালাক্সির জোট) অনেক দূরের গ্যালাক্সি ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের (৩০ বিলিয়ন লাইটিয়ার) আকার বাড়িয়ে দিয়েছে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নামে পরিচিত একটি প্রাকৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইনফ্রারেড আলোতে ওয়েব দুরবিনের অনেক ভালো রেজলুশন। লেন্সিঙের মাধ্যমে বড় হওয়া গ্যালাক্সিকে উচ্চ রেজলুশনের ক্যামেরা দিয়ে অনেক ভাগে ভাগ করা হয়েছে বলেই জানা গেছে অনেক কিছু।
“গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিঙের সাহায্য না পেলে আমরা এই গ্যালাক্সি কোনভাবেই রিজল্ভ করে দেখতে পারতাম না,” বলেছেন পেপারটির আরেক জন কো-লিড কার্তিক আয়ার, যিনি নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে নাসা হাবল ফেলো। তিনি আরো বলেন, “বর্তমান ফিজিক্সের ভিত্তিতে আমরা এমন কিছু আশা করতে হবে জানতাম, কিন্তু তার পরও আসলেই দেখতে পেয়ে বিস্মিয় হয়েছি।”
ওয়েবের ছবিতে গ্যালাক্সিটি সনাক্ত করেছেন লামীয়া। তাকে আকর্ষণ করেছিল এর ভিতরের স্টার ক্লাস্টারগুলো, কারণ এত ঝলমল করার অর্থ হচ্ছে বস্তুটা অনেক ভাগে বিভক্ত এবং অনেক জটিল। গ্যালাক্সিটি রাতের অন্ধকারে জ্বলা জোনাকির ঝাঁকের মতো স্পার্ক করছে দেখেই তারা এর নাম দিয়েছেন ফায়ারফ্লাই স্পার্কল।
গ্যালাক্সির রূপ পুনর্গঠন
লেন্সিঙের কারণে লম্বা হয়ে না গেলে গ্যালাক্সিটি দেখতে কেমন হতো তা মডেল করে গবেষক দলের বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে এর আসল রূপ অনেকটা বৃষ্টির ফোঁটার মতো। এর মধ্যে ঝুলছে উপরের দিকে দুটি এবং নিচের দিকে আটটি স্টার ক্লাস্টার। “আমাদের পুনর্গঠন থেকে বুঝা যাচ্ছে, এখানে সক্রিয়ভাবে নতুন তারার জন্ম দিতে থাকা বিভিন্ন গ্যাসখণ্ড আছে, যাদের চারদিকে দেখা যায় অন্যান্য রিজল্ভ-না-করা তারার বিক্ষিপ্ত আলো,” বলেন আয়ার, “এই গ্যালাক্সি আসলেই জোড়া লাগার প্রক্রিয়ায় আছে।”
ওয়েবের ডেটা থেকে দেখা যাচ্ছে ফায়ারফ্লাই স্পার্কল তুলনামূলকভাবে ছোট, লো-মাস বা কম ভরের গ্যালাক্সির দলে। কয়েক বিলিয়ন বছর সময় লাগবে তার ভর যথেষ্ট বাড়তে এবং একটি নির্দিষ্ট আকৃতি তৈরি হতে। “ওয়েব আমাদেরকে অন্য যেসব গ্যালাক্সি দেখিয়েছে সেগুলো প্রসারিত বা বিবর্ধিত নয়, যার ফলে তাদের ‘গাঠনিক ব্লকগুলো’ আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যায় না। ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের ক্ষেত্রে আমরা একটি গ্যালাক্সিকে ধাপে ধাপে গড়ে উঠতে দেখছি,” বলেন লামীয়া।
লেন্সিঙের টানে প্রসারিত গ্যালাক্সির বিশ্লেষণ
মহাকর্ষীয় লেন্সিঙের কারণে গ্যালাক্সিটি প্রসারিত হয়ে একটি বাঁকা আর্ক তৈরি করেছে বলে গবেষকরা সহজেই ১০টি আলাদা স্টার ক্লাস্টার সনাক্ত করতে পেরেছেন, যেগুলো থেকেই গ্যালাক্সিটির অধিকাংশ আলো আসছে। এগুলো ছবিতে পিংক, পার্পল ও নীল রঙে দেখানো হয়েছে। ওয়েব দিয়ে ধারণ করা ইমেজ ও স্পেক্ট্রাম থেকে জানা গেছে, এই গ্যালাক্সিতে সব তারার জন্ম একসাথে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে।
“এই গ্যালাক্সির বিভিন্ন স্টার ক্লাস্টারে তারার পপুলেশনে অনেক বৈচিত্র্য আছে, এবং এটা আসলেই উল্লেখযোগ্য যে মহাবিশ্বের এত প্রাচীন সময়েও আমরা এদেরকে আলাদাভাবে দেখতে পাচ্ছি,” বলেন কানাডার হার্জবার্গ এস্ট্রোনমি এন্ড এস্ট্রোফিজিক্স রিসার্চ সেন্টারের ক্রিস উইলট, যিনি এই পেপারের কো-অথর এবং এই পর্যবেক্ষণ প্রগ্রামের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর। “তারার একেকটি খণ্ড জন্মের বা বিবর্তনের একেক দশায় আছে।”
এই গ্যালাক্সির প্রজেক্টেড আকৃতি থেকে বুঝা গেছে এর তারাগুলো এখনো কোনো কেন্দ্রীয় বাল্জ বা সমতল সরু ডিস্কে থিতু হয়নি, যা প্রমাণ করে গ্যালাক্সিটির গঠন প্রক্রিয়া এখনো চলছে।
সুদীপ্ত সঙ্গী
গবেষকরা আগে থেকে বলতে পারবেন না এই গ্যালাক্সি কয়েক বিলিয়ন বছরে বড় হতে হতে কিভাবে পূর্ণতা অর্জন করবে, কিন্তু তারা দেখেছেন খুব কাছেই মহাকর্ষের টানে আবদ্ধ একটা জায়গায় ঘোরাফেরা করছে আরো দুটি গ্যালাক্সি, যারা সম্ভবত আগামী কয়েক বিলিয়ন বছরে এর ভর বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
ফায়ারফ্লাই স্পার্কল তার প্রথম সঙ্গী থেকে মাত্র ৬,৫০০ লাইট ইয়ার দূরে, এবং দ্বিতীয় সঙ্গী থেকে ৪২,০০০ লাইট ইয়ার দূরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের মিল্কিওয়ের ব্যাস প্রায় ১ লাখ লাইট ইয়ার, অর্থাৎ ফায়ারফ্লাই ও তার দুই সঙ্গী তিন জনকেই মিল্কিওয়ের সীমার মধ্যে আঁটানো সম্ভব। শুধু তাই নয়, গবেষকরা মনে করেন তারা তিন জন একে অপরকে আবর্তনও করছে।
যখনি এক গ্যালাক্সি অন্য গ্যালাক্সির কাছ দিয়ে যায়, তাদের গ্যাস ঘন ও ঠাণ্ডা হয়, যার ফলে নতুন নতুন গ্যাসখণ্ডে তারার জন্ম শুরু হয় এবং গ্যালাক্সির ভর বাড়ে। “অনেক দিন থেকেই বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রাচীন মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি গঠিত হয়েছিল ছোট ছোট অনেক গ্যালাক্সির সাথে একের পর এক ইন্টারেকশন ও মার্জিঙের মাধ্যমে,” বলেন ইয়োশিহিসা আসাদা, এই পেপারের একজন কো-অথর এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী। “আমরা সম্ভবত এই প্রক্রিয়া সরাসরি দেখছি।”
“ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের মতো অনেক দূরের পুরনো গ্যালাক্সিগুলো এবং এদের মধ্যে থাকা স্টার ক্লাস্টার বিশ্লেষণ করে এদের গঠন প্রক্রিয়া জানা সম্ভব যা আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে অনেক অজানা রহস্যের সমাধান দিতে পারে।” বলেন পেপারের কো-অথর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান।
এই গবেষক টিম ওয়েব দুরবিনের ডেটার জন্য কানাডিয়ান নিয়ারিস আনবায়াজড ক্লাস্টার সার্ভে’র (ক্যানাক্স) উপর নির্ভর করেছে, যার মধ্যে আছে নিয়ারক্যাম (নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা) থেকে পাওয়া ইনফ্রারেড ছবি এবং নিয়ারস্পেকে (নিয়ার-ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোগ্রাফ) থাকা মাইক্রোশাটার অ্যারে’র স্পেক্ট্রাম। ক্যানাক্স ডেটা ইচ্ছা করেই আকাশের এমন একটা অংশ কাভার করেছে যা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে অব্জার্ভ করা হয়েছিল ক্লাস্টার লেন্সিং এন্ড সুপারনোভা সার্ভে উইথ হাবল (ক্ল্যাশ) প্রগ্রামের অংশ হিসেবে।
এই গবেষণা ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আইইউবি’র নবনির্মিত সেন্টার ফর এস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্স এন্ড এস্ট্রোফিজিক্সের এফিলিয়েশনে এই প্রথম কোনো কোনো সায়েন্টিফিক পেপার প্রকাশিত হলো।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বর্তমানে পৃথিবীর প্রধান স্পেস সায়েন্স অব্জার্ভেটরি। ওয়েব আমাদের সৌরজগতের অনেক রহস্যের সমাধান করছে, দূরের অনেক তারার চারদিকে খুঁজছে নতুন নতুন গ্রহ, অনুসন্ধান করছে মহাবিশ্বের রহস্যময় কাঠামো ও উৎপত্তি এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান। ওয়েব একটি আন্তর্জাতিক প্রগ্রাম যার নেতৃত্ব দিচ্ছে নাসা এবং তার পার্টনার এসা (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি) ও সিএসএ (কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি)।
এই লেখাটি তৈরির জন্য নাসা’র ওয়েবসাইট থেকে প্রাথমিক অনুবাদ ও কিছু সংযোজন করেছেন নুসরাত জাহান। সার্বিক সম্পাদনা ও আরো কিছু সংযোজন করেছেন কাসা’র পরিচালক, আইইউবি’র সহকারী অধ্যাপক খান মুহাম্মদ বিন আসাদ।
প্রাসঙ্গিক লিংক
- Formation of a low-mass galaxy from star clusters in a 600-million-year-old Universe, Nature.
- Found: First Actively Forming Galaxy as Lightweight as Young Milky Way, NASA.
- Firefly Sparkle galaxy offers a taste of the infant Milky Way, Reuters.
- ‘Christmas lights’ galaxy reveals how Universe formed, BBC.
- A new galaxy, much like our own, Wellesley.
- Scientist from IUB’s Center for Astronomy publishes major research in Nature on an actively forming galaxy using JWST, IUB.