অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো
আজ থেকে চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে বিগব্যাং নামের এক অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে আমাদের ইউনিভার্সের জন্ম। এই মহাবিশ্বে কয়েক ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি থাকতে পারে, এবং এই সব গ্যালাক্সিই তৈরি হয়েছিল প্রথম এক-দুই বিলিয়ন বছরের মধ্যে। তার মানে গ্যালাক্সি নির্মাণ খুব দ্রুত শুরু হয়েছিল, কিন্তু ঠিক কবে, বিগব্যাঙের কত বছর পর, কিভাবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য রেডিও থেকে অপ্টিকেল হয়ে এক্সরে পর্যন্ত সব এস্ট্রোনমিতেই কঠিন কাজ চলছে। ইউনিভার্সের প্রথম যে-ছবিটা আমাদের কাছে আছে তা তোলা হয়েছে মাইক্রোওয়েভ লাইট দিয়ে, যা উপরের ছবিতে কসমিক মাইক্রোয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। তখন ইউনিভার্সের বয়স ছিল চার লাখ বছরের মতো, মানে পৃথিবীতে মানুষের বয়সের প্রায় সমান। সেই বয়সে ইউনিভার্স ছিল একটা সিঙ্গেল গ্যাস যার সবখানে টেম্পারেচার ও ডেন্সিটি প্রায় সমান, তবে কিছুটা ভেরিয়েশন ছিল। মাইক্রোওয়েভ ছবিটাতে ইউনিভার্সের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার তাপমাত্রার গড় পার্থক্য কয়েক মাইক্রোকেলভিন। অতিসামান্য ভেরিয়েশনের এই হোমোজেনাস গ্যাস থেকে মাত্র পঞ্চাশ থেকে একশ কোটি বছরের মধ্যে কিভাবে লক্ষ কোটি গ্যালাক্সির জন্ম হলো? এ এক বিশাল রহস্য, যেমন এস্ট্রোনমিতে, তেমন এস্ট্রোফিজিক্সে।
রহস্য কারণ চার লাখ থেকে চল্লিশ কোটি বছর বয়সের মধ্যে ইউনিভার্সের কোনো ছবি আমরা তুলতে পারিনি। চার লাখ বছর বয়সে কোনো গ্যালাক্সিই ছিল না, আর চল্লিশ কোটি বছর বয়সে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। মাঝখানে কি হলো? এই মাঝের সময়টার নাম এখন ডার্ক এইজ ও কসমিক ডন, দুইটাকে একসাথে ইউনিভার্সের টিনেইজ বলা যায়। জেডব্লিউএসটি সবচেয়ে পুরানো যে-গ্যালাক্সির ছবি তুলতে পারবে তাও ইউনিভার্সের সাতাশ কোটি বছর বয়সের সময়কার। কোথায় চার লাখ, কোথায় সাতাশ কোটি। তাছাড়া এই টেলিস্কোপ দিয়ে সামান্য কিছু দিকে টিনেইজের অল্প কিছু গ্যালাক্সির ছবি তোলা যাবে, যা সারা মহাবিশ্ব বুঝার জন্য যথেষ্ট না।
রহস্যটা সমাধানের জন্য তাই রেডিও এস্ট্রোনমাররা অন্য এক সিগ্নালের প্রেমে পড়েছেন। সিগ্নালটা এমন এক ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ওয়েভ যার আসল লেন্থ ২১ সেন্টিমিটার, কিন্তু ইউনিভার্সের প্রসারণের কারণে সে কয়েক মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে যেতে পারে। এটা তৈরি হয় নিউট্রাল হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে। ইউনিভার্সের মোট পদার্থের পচাত্তর পার্সেন্টই হাইড্রোজেন। বলা যায় ইউনিভার্স যদি একটা সমুদ্র হয়, তাহলে সমুদ্রের পানি হবে হাইড্রোজেন, আর সেই পানিতে অনেক দূরে দূরে ভাসমান ছোট ছোট জাহাজগুলো হবে গ্যালাক্সি। হাইড্রোজেনের সমুদ্রে গ্যালাক্সিরা এতই নগণ্য। আমরা যদি সরাসরি এই হাইড্রোজেনের ছবি তুলতে পারি, তাহলে আলাদা করে প্রতিটা গ্যালাক্সির ছবি না তুলেও ইউনিভার্সের মানচিত্র বানানো সম্ভব হবে। আর ছবিটা যদি চার লাখ থেকে চল্লিশ কোটি বছরের মধ্যে প্রত্যেক বয়সে তোলা যায় তাহলে ইউনিভার্সের সার্বিক পরিবর্তনের ছবিটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন বানানো যাবে মহাবিশ্বের টাইমল্যাপ্স ম্যাপ, গুগল আর্থ যেমন বানিয়েছে পৃথিবীর সার্ফেসের টাইমল্যাপ্স ম্যাপ।
ছবি তুলতে আলো লাগে। ভাগ্য ভালো হাইড্রোজেন নিজেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ২১ সেমি দৈর্ঘের একটা আলো তৈরি করতে থাকে, যাকে আমরা একুশে তরঙ্গ বা সিগ্নাল ডাকব। এই আলো যত অতীত থেকে আসবে তত লম্বা হয়ে যাবে। এক কোটি বছর বয়সের হাইড্রোজেন থেকে আসা ২১ সেমি সিগ্নাল আমাদের কাছে পৌঁছাবে প্রায় ৩০ মিটার ওয়েভলেন্থের তরঙ্গ হিসাবে। আর চল্লিশ কোটি বছরের হাইড্রোজেন থেকে আসা একুশে তরঙ্গ আমরা দেখব প্রায় আড়াই মিটার লম্বা। সুতরাং রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে ২ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত প্রত্যেক দৈর্ঘের তরঙ্গ যদি আমরা খুব সূক্ষ্মভাবে মাপতে পারি, তাহলেই এক থেকে চল্লিশ কোটি বছর বয়স পর্যন্ত ইউনিভার্সের বেড়ে ওঠার মুভি বানানো হয়ে যাবে হাইড্রোজেনের মাধ্যমে।
এই মুভি বানানো অত সোজা না। মুভি বানাতে হলে ৩৬০ ডিগ্রির প্রায় প্রত্যেক দিক থেকে আসা সিগ্নাল ধরতে হবে, এবং প্রত্যেক দিকেই টেলিস্কোপের সেন্সিটিভি ও রেজলুশন খুব ভালো হতে হবে। এমন টেলিস্কোপ কয়েক মিটারের মতো বড় তরঙ্গদৈর্ঘে, অর্থাৎ দশ থেকে দুইশ মেগাহার্জের মতো কম কম্পাঙ্কে বানানো খুবই কঠিন। কঠিন বলেই তা সায়েন্টিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ারদের আদরের জিনিস। তাই অনেক দেশে বানানো হয়েছে, এখনো হচ্ছে, অনেক রকমের রেডিও টেলিস্কোপ।
নেদারল্যান্ডের লোফার (লো ফ্রিকোয়েন্সি অ্যারে), অস্ট্রেলিয়ার এমডব্লিউএ (মার্চিসন ওয়াইডফিল্ড অ্যারে), যুক্তরাষ্ট্রের অভ্র-এলডব্লিউএ (ওয়েন্স ভ্যালি রেডিও অব্জার্ভেটরি – লং ওয়েভলেন্থ অ্যারে), ফ্রান্সের নেনুফার (নিউ এক্সটেনশন ইন নান্সে আপগ্রেডিং লোফার), সাউথ আফ্রিকার হেরা (হাইড্রোজেন ইপক অফ রিআয়োনাইজেশন অ্যারে), এবং অস্ট্রেলিয়ার ভবিষ্যৎ এসকেএ-লো (স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারে – লো ফ্রিকোয়েন্সি) বিভিন্ন দিকে একুশে তরঙ্গের স্থানিক ফ্লাকচুয়েশন মাপতে চায়। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার এজেস (এক্সপেরিমেন্ট টু ডিটেক্ট দ্য গ্লোবাল ইওআর সিগ্নেচার) ও ভারতের সারাস (শেইপড এন্টেনা মেজারমেন্ট অফ দ্য ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিও স্পেক্ট্রাম) আকাশের সব দিক থেকে আসা একুশে তরঙ্গের গ্লোবাল গড় মান মাপতে চায়। এজেস ইতিমধ্যে তেইশ কোটি বছর বয়সের হাইড্রোজেনের একটা গ্লোবাল সিগ্নাল আবিষ্কারের দাবি করেছে।
এরা সবাই এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১০০ কোটি বছর বয়সের ছবি তোলার চেষ্টা করছে। কত দূর সফল হয় দেখা যাক। কিন্তু দশ কোটির চেয়েও কম বয়সে ইউনিভার্সের হাইড্রোজেনে কি ঘটছিল তা গ্রাউন্ডের টেলিস্কোপ দিয়ে কখনোই বুঝা সম্ভব না। কারণ দুই ধরনের দূষণ: মানুষের তৈরি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ইন্টারফেয়ারেন্স (আরএফআই), আর পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ার। এই দুই পাষাণের টর্চার থেকে মুক্তি পেতে হলে স্পেসে যেতে হবে। এবং যাওয়ার পরিকল্পনাও অনেক দেশ ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। নেদারল্যান্ড ও চীন একসাথে মিলে ২০১৮ সালে চাঁদের পিছনে আর্থ-মুন এলটু পয়েন্টে পাঠিয়েছে এনসিএলই (নেদারল্যান্ডস-চায়না লো-ফ্রিকোয়েন্সি এক্সপ্লোরার), যুক্তরাষ্ট্র প্ল্যান করছে ড্যাপার (ডার্ক এইজেস পোলারিমিটার পাথফাইন্ডার) ও ফারসাইড (ফারসাইড অ্যারে ফর রেডিও সায়েন্স ইনভেস্টিগেশন্স অফ দ্য ডার্ক এইজেস এন্ড এক্সোপ্ল্যানেটস) নামে দুইটা মিশন, চাঁদের অর্বিটে পাঠানোর জন্য চায়নার পরিকল্পনায় আছে ডিএসএল (ডিস্কাভারিং দ্য স্কাই অ্যাট দ্য লংগেস্ট ওয়েভলেন্থস), আর ভারতে প্ল্যান করা হচ্ছে প্রত্যুষ (প্রোবিং রিআয়োনাইজেশন অফ দ্য ইউনিভার্স ইউজিং সিগ্নাল ফ্রম হাইড্রোজেন)।
কেন এত প্রতিযোগিতা? স্পেসে যদি একাধিক রেডিও এন্টেনার সমন্বয়ে বানানো ইন্টারফেরোমিটার পাঠানো হয় এবং তা যদি চাঁদকে শিল্ড হিসেবে ইউজ করে আমাদের আরএফআই থেকে পুরাপুরি মুক্তি পায়, তাহলে তার মাধ্যমে ফিজিক্স ও এস্ট্রোফিজিক্সের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করা যাবে। এসব বিষয়ের মধ্যে আছে ইনফ্লেশন, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, বিশাল স্কেলে গ্র্যাভিটির আচরণ, উইম্প নিউট্রিনো বা এক্সিয়নের মতো কণার পার্টিকেল ফিজিক্স, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ, মহাবিশ্বের লার্জ-স্কেল স্ট্রাকচারে নন-গাউসিয়ানিটি, প্রাইমর্ডিয়াল ব্ল্যাক হোল। এই সব বিষয় ফিজিক্সের মৌলিক থিওরির সাথে সম্পর্কিত। তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হবে ইউনিভার্সের ১০ থেকে ৩০ কোটি বছর বয়সের মধ্যে (কসমিক ডন) তারা ও গ্যালাক্সি নির্মাণের পুরা প্রসেসের মুভি তৈরি করা যা এস্ট্রোফিজিক্সের অনেক মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে। বিশেষ করে আমরা জানতে পারব প্রথম কিভাবে তৈরি হয়েছিল তারা-সাইজের ব্ল্যাক হোল, আর হিলিয়ামের চেয়ে ভারী সব কেমিকেল এলিমেন্ট।
তার মানে মহাবিশ্বের সব হাইড্রোজেন অব্জার্ভ করা আসলেই দরকার। হাইড্রোজেন থেকে আসা একুশে তরঙ্গের গ্লোবাল এভারেজ যেমন মাপতে হবে, তেমনি লাগবে বিভিন্ন দিকে ফ্লাকচুয়েশনের লোকাল মানচিত্র। এই গ্লোবাল ও লোকাল টাইমল্যাপ্স বানাতে হলে স্পেসে আরো উন্নত রেডিও অ্যারে বসাতে হবে, যা অন্তত পাঁচ বছর ধরে অব্জার্ভেশন চালাতে পারবে ১ থেকে ১০০ মেগাহার্জে, যার কালেক্টিং এরিয়া হবে ১ থেকে ১০০ বর্গকিলোমিটার, আর ফিল্ড-অফ-ভিউ হবে পুরা সাড়ে বারো ($4\pi$) স্টেরেডিয়ান। আমি যার সুপারভিশনে পিএইচডি করেছিলাম নেদারল্যান্ডের খ্রোনিঙেনে সেই প্রফেসর লেয়ন কোপমান্স এজন্য ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (এসা) কাছে কোডেক্স (কসমিক-ডন ডার্ক-এইজেস এক্সপ্লোরার) নামে একটা মিশন প্রস্তাব করেছেন ২০২১ সালে। কোডেক্সের প্রেক্ষাপটে তার হোয়াইট পেপার অনুসরণ করেই এখানে আর কয়েকটা কথা বলতে চাই।
কোডেক্সের টার্গেট ১০ কোটি বছর বয়সের ইউনিভার্স। দশ কোটি বছর বয়সে ইউনিভার্সের ডার্ক এইজ শেষ হয়েছে, আর কসমিক ডন শুরু হয়েছে। মানে আনুমানিক এই সময়েই অন্ধকারের উৎস হতে প্রথম উৎসারিত হয়েছে আলো। হোয়াইট পেপারে বিশেষভাবে দুইটা সময় দেখার হিসাব দেয়া হয়েছে, যখন ইউনিভার্সের বয়স ছিল আনুমানিক ১০ কোটি ও ৫ কোটি বছর। উদ্দেশ্য হলো এই দুই সময়েই হাইড্রোজেনের পাওয়ার স্পেক্ট্রাম মাপা, আর টমোগ্রাফি করা। পাওয়ার স্পেক্ট্রাম আমাদের জানায় কোন স্কেলে ব্রাইটনেস কেমন, মানে পাওয়ার ছোট ছোট স্ট্রাকচারে বেশি, না কি বড় বড় স্ট্রাকচারে বেশি। আর টমোগ্রাফি মানে ওয়েভের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক মানচিত্র বানানো।
পাওয়ার স্পেক্ট্রাম ও টমোগ্রাফি, দুই কাজেই কোডেক্স চায় সিগ্নাল হোক নয়েজের দশ গুণ। এজন্য টেলিস্কোপের তিনটা জিনিস খুব ভালো হতে হবে: কালেক্টিং এরিয়া, ফিলিং ফ্যাক্টর, ফিল্ড-অফ-ভিউ। কালেক্টিং এরিয়া মানে কত বর্গকিমি এলাকায় পড়া ফোটন কালেক্ট করা যাবে, এরিয়া যত বেশি হবে তত বেশি আলো ধরা যাবে। ফিলিং ফ্যাক্টর মানে অ্যারের সেন্টারের দিকে এন্টেনার ঘনত্ব, এন্টেনা যত বেশি এই ফ্যাক্টর তত বড়। আর ফিল্ড-অফ-ভিউ হলো আকাশের মোট কত ডিগ্রি এলাকা অব্জার্ভ করা যাবে সেটা। কোপমান্স হিসাব করে দেখেছেন, দশ কোটি বছর বয়সি ইউনিভার্স মোটামুটি দেখতে হলে কালেক্টিং এরিয়া হতে হবে মিনিমাম ১ বর্গকিমি, কিন্তু পাঁচ কোটি বছরে যেতে হলে তা অন্তত ১০ বর্গকিমি পর্যন্ত বাড়াতে হবে, আর বিস্তারিত টমোগ্রাফির জন্য কালেক্টিং এরিয়া হতে হবে ১০০ বর্গকিমি। এবং ১০ মেগাহার্জ ব্যান্ডউইডথে অব্জার্ভেশন করতে হবে অন্তত পাঁচ বছর ধরে।
এই কাজটা করা যায় হাজার হাজার কিউবস্যাটের ঝাঁক (সোয়ার্ম) দিয়ে। এক থেকে দশ কেজি ভরের একেকটা কিউবস্যাটে ১ থেকে ৮০ মেগাহার্জে সেন্সিটিভ একেকটা ডাইপোল বা ট্রাইপোল রেডিও এন্টেনা বসানো থাকবে। মাঝখানে একটা মাদারশিপে সব ন্যান-স্যাটেলাইটের এন্টেনার অব্জার্ভেশনের কোরিলেশন করা হবে। মাদারশিপ ও সোয়ার্ম একসাথে মিলে হবে একটা কনস্টেলেশন। কেন্দ্রের দিকে এন্টেনার সংখ্যা বেশি হবে সেন্সিটিভিটি বাড়ানোর জন্য, আর অনেক দূরে দূরে কম সংখ্যক এন্টেনা উড়বে রেজলুশন বাড়ানোর জন্য। অ্যারেটা এমন জায়গায় বসাতে হবে যেখানে আরএফআই নেই, যেমন, সান-আর্থ এলটু পয়েন্ট, বা চাঁদের অর্বিট। কোর এন্টেনাদের সাথে মাদারশিপের যোগাযোগ হতে পারে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে, কিন্তু দূরের এন্টেনার সাথে যোগাযোগে লেজারের মতো অপ্টিকেল কমুনিকেশন ইউজ করা যায়।
তবে আরেকটা বিকল্প আছে। স্পেসে না বসিয়ে চাঁদের ফারসাইডে বা মেরু অঞ্চলেও কোডেক্স বসানো সম্ভব, যেমন করে পৃথিবীর সার্ফেসে লোফার বা হেরা বানানো হয়েছে। এক্ষেত্রেও আমরা পৃথিবীর আরএফআই ও আয়নোস্ফিয়ার থেকে মুক্তি পাব। চাঁদের সার্ফেসে ১ থেকে ১০০ মেগাহার্জে অব্জার্ভেশন করতে পারে এমন ৩০ হাজার থেকে ৩০ লাখ এন্টেনা বসাতে হবে ১ থেকে ১০০ বর্গকিমি কালেক্টিং এরিয়ার জন্য। ট্রেডিশনাল ডাইপোল বা ট্রাইপোল এন্টেনাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। লোকেশন হিসেবে চাঁদের ফারসাইড সবচেয়ে ভালো, কিন্তু সেক্ষেত্রে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের জন্য আলাদা একটা অর্বিটার লাগবে। এক্ষেত্রে ডেটা প্রসেসিংও চাঁদের মাটিতে না করে অর্বিটারে করা ভালো।
স্পেসে কিউবস্যাটের ঝাঁক দিয়ে যদি কোডেক্স বানানো হয়, তাহলে ইনফ্লেটেবল এন্টেনা একটা ভালো অপশন হতে পারে। স্যাটেলাইট জায়গামতো পৌঁছানোর পর ইনফ্লেটেবল এন্টেনার রিফ্লেক্টর বা কালেক্টর বেলুনের মতো খুলে যাবে। এক্ষেত্রে স্পেসে হাজার হাজার এন্টেনা ডিপ্লয় করার খরচ কম হতে পারে, রকেটে জায়গা কম লাগতে পারে। নাসা’র ইনফ্লেটেবল এন্টেনা এক্সপেরিমেন্ট এখানে অনুসরণীয়। বা নাসা ষাটের দশকে একো ২ নামের কমুনিকেশন স্যাটেলাইট প্রজেক্টে বেলুনের মতো যে এন্টেনা ইউজ করেছিল তাও কোডেক্সে কাজে লাগানো যায়। বর্তমানে স্যাটেলাইট লঞ্চিঙের খরচ যেভাবে কমছে তাতে শীঘ্রই কোডেক্সের মতো মিশন স্পেসে বসানো ফিজিবল হয়ে যাবে।
চাঁদের ফারসাইডে করার একটা বড় সুবিধা সুদূর ভবিষ্যতে পাওয়া যেতে পারে। এটা হলো চাঁদের ম্যাটারিয়াল ইউজ করে এন্টেনা অ্যারে বানানোর চেষ্টা। চাঁদের সার্ফেসে মাটি ধুলা ও পাথর পাওয়া যায়, যার সাধারণ নাম রেগোলিথ। এর মধ্যে টাইটেনিয়াম ডায়োক্সাইড, এলুমিনিয়াম অক্সাইড ও ফেরাস অক্সাইড আছে, যা থেকে মেটাল বের করা সম্ভব। এসব মেটাল দিয়ে তড়িৎ পরিবাহী এন্টেনা বানানো যেতে পারে। তবে এই প্রসেস হতে হবে অটোমেটেড। এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং নামে একটা প্রসেস নিয়ে নাসা এসা সবাই এক্সপেরিমেন্ট করছে, এর উদ্দেশ্য চাঁদে বা মঙ্গলে কলোনি স্থাপনের সময় স্থানীয় রিসোর্সের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার। ভবিষ্যতে এই সিস্টেম আরো উন্নত হলে রেডিও এস্ট্রোনমিতেও কাজে লাগবে। এটা খুবই দরকারি কারণ কালেক্টিং এরিয়া বাড়ানোর জন্য আমাদের অনেক এন্টেনা লাগবে, এত এন্টেনা পৃথিবী থেকে নিয়ে না গিয়ে চাঁদের সার্ফেসে থাকা রোবট দিয়ে বানানোতে খরচ আরো কম লাগতে পারে।
এক, দশ বা একশ বর্গকিমি কালেক্টিং এরিয়ার স্পেস ইন্টারফেরোমিটার রাতারাতি বানানো সম্ভব না, এটা করতে হবে ধীরে ধীরে, স্টেপ বাই স্টেপ। একারণেই কোডেক্সের ডিজাইন খুবই ফ্লেক্সিবল ও স্কেলেবল রাখা হয়েছে। এমনকি ০.১ বর্গকিমি কালেক্টিং এরিয়ার একটা অ্যারে দিয়েও কাজ শুরু করা যায় যা হতে পারে কোডেক্স পাথফাইন্ডার। এর সফলতার উপর ভিত্তি করে দিন দিন আরো এন্টেনা যোগ করার মাধ্যমে কালেক্টিং এরিয়া বাড়াতে থাকা যায়।
কোডেক্সের মতো মিশনের জন্য যেসব প্রযুক্তি লাগবে তাদের টেকনোলজি রেডিনেস লেভেল (টিআরএল) কোপমান্স উল্লেখ করেছেন। টিআরএল হলো ১ থেকে ৯ এর মধ্যে একটা নাম্বার, ১ মানে প্রযুক্তিটা নিয়ে বেসিক রিসার্চ শুরু হয়েছে, আর ৯ মানে তা ইতিমধ্যে সফলভাবে অপারেট করছে। সত্তরের দশকে নাসাই সিস্টেমটা তৈরি করেছিল। হালকা, ফোল্ডেবল, ইনফ্লেটেবল এন্টেনার ক্ষেত্রে টিআরএল এখন ৫, কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৭ হয়ে যেতে পারে। কম পাওয়ার খেয়ে অনেক বেশি প্রসেসিং করতে পারে ২০০ মেগাহার্জে এমন রেডিও রিসিভারের টিআরএল এখন ৬, কিন্তু ভবিষ্যতে ৭ হবে। ডিজিটাল প্রসেসিং সিস্টেম এখন ৪, কিন্তু এই দশকের মধ্যে ৭ হবে। অপ্টিকেল কমুনিকেশনের প্রযুক্তি যা লাগবে তার টিআরএল এই দশকের শেষেই ৯ হয়ে যাবে। সোয়ার্ম টেকনোলজি এদের তুলনায় একটু পিছিয়ে আছে, স্যাটেলাইটের এত বড় ঝাঁক ডিপ্লয় করার প্রযুক্তি এখনো ফিজিবিলিটি রিসার্চের পর্যায়ে আছে, মানে টিআরএল ৩-এ, তবে এই দশকের মধ্যে বেড়ে ৬ হবে। ইনফ্লেটেবল স্পেস স্ট্রাকচার এবং রোবট দিয়ে এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিঙের টিআরএল এই দশকের মধ্যে আটের মতো হবে। মোটের উপর বলা যায়, এই দশকের শেষে একমাত্র সোয়ার্ম টেকনোলজি ছাড়া বাকি সব প্রযুক্তির টিআরএল-ই সাতে উঠবে বা সাত ছাড়িয়ে যাবে, মানে ডেভেলপমেন্ট ছাড়িয়ে ডেমনস্ট্রেশনের পর্যায়ে থাকবে, বা কোনো কোনোটা অপারেশনেও চলে যাবে।
গ্রাউন্ডে একই ধরনের কাজের জন্য সবচেয়ে বড় যে টেলিস্কোপ সাউথ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে বানানো হচ্ছে তার কাজও এই দশকের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এর নাম স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারে রাখাই হয়েছিল এই কারণে যে, তার কালেক্টিং এরিয়া শুরুতে ১ বর্গকিমি প্রস্তাব করা হয়েছিল। যতদিনে এসকেএ শেষ হবে ততদিনে হয়ত তার চেয়েও অনেক বড় স্পেস অ্যারের কাজ হয়ত শুরু হয়ে যাবে। এই সবকিছুর উদ্দেশ্য ইউনিভার্সের ডার্ক এইজে উঁকি দেয়া, কারণ ডার্ক এইজের মধ্যেই আছে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্বের ইতিহাসের আসল চাবিকাঠি।
কারণটা এই রকম। ইউরোপিয়ানরা তাদের মধ্যযুগকে অনেক সময় ডার্ক এইজ বলে, যদিও আধুনিক অনেক ইতিহাসবিদ এর সাথে একমত না। কারণ ডার্ক এইজেই ইউরোপের রেনেসাঁ ও রেভলুশনের বীজ বোনা হয়েছে, ডার্ক এইজ না বুঝলে কখনো ইতালির রেনেসাঁ বা জার্মানি-ফ্রান্সের এনলাইটেনমেন্ট বুঝা সম্ভব না, ইংল্যান্ডের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলুশন তো আরো সম্ভব না। একইভাবে বলা যায় ইউনিভার্সের ডার্ক এইজ না বুঝলে, প্রথম ১০ কোটি বছর মহাবিশ্বের মধ্যে কি ঘটছিল তা না জানলে ফিজিক্সের মৌলিক সমস্যাগুলোরও সমাধান সম্ভব না। আর মহাবিশ্বের ডার্ক এইজ বুঝা আসলে আরো বেশি সহজ, যদি একবার অব্জার্ভ করা যায়। কারণ ডার্ক এইজে ইউনিভার্স ছিল যাকে বলে প্রিস্টিন, তখনো স্টার বা গ্যালাক্সির ডেন্সিটি অত বাড়েনি, ফলে টার্বুলেন্সের মতো জটিল এস্ট্রোফিজিক্সের প্রভাব তখনো কম ছিল। এই পিউর পরিবেশে কসমোলজির স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা পার্টিকেল ফিজিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অনেক কিছু টেস্ট করা সম্ভব। কাজটা সোজা হবে না, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ আবিষ্কার বা হিগস বোসন আবিষ্কার যত কঠিন ছিল ততই, বা তার চেয়েও বেশি কঠিন হবে, কিন্তু আবিষ্কার যত কঠিন পুরস্কার তত বড়। একবার ডার্ক এইজের একুশে তরঙ্গ পেয়ে গেলে ফিজিক্স ও এস্ট্রোফিজিক্সের অনেক হাইপোথিসিস চলে আসবে টেস্টিঙের নাগালে। আবারো প্রমাণিত হবে, অন্ধকারের উৎস থেকেই উৎসারিত হয় আলো।