Table of Contents
This is an old revision of the document!
স্পিনোজা
স্পিনোজা ১৭–১৮ শতকে ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। তার প্রধান বই এথিক্স এবং থিওলজিকেল-পলিটিকেল ট্রিটিজ। ‘এথিক্সে’ তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতিক মেথডে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে গড আছেন এবং এই গডকে জানার চেষ্টা করাই মানুষের জন্য সর্বোত্তম গুড। তিন খণ্ডের প্রথমটাতে বলেন, গড ও নেচার একই জিনিস, খোদা ও প্রকৃতি এক। গড বাস্তবতার ইউনিক অসীম অবশ্য-বিরাজমান সাবস্টেন্স। সাবস্টেন্স শুধু একটাই আছে, তা হলো গড।
খোদা ও প্রকৃতি
এরিস্টটলের মতে সাবস্টেন্স তাই যা অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না, আর এট্রিবিউট সাবস্টেন্সের উপর নির্ভরশীল। যেমন ‘মানুষ’ ধারণাটা অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না, তাই এটা সাবস্টেন্স। কিন্তু ‘ওজন’ সব সময় কিছু একটার ওজন, যে কিছু একটা হলো সাবস্টেন্স, তাই ওজন এক ধরনের এট্রিবিউট। দেকার্ত এর সাথে যোগ করেন, অসংখ্য সাবস্টেন্সের অসংখ্য পরিবর্তনশীল প্রপার্টি থাকলেও একটা প্রপার্টি কখনো পাল্টায় না: একটা সাবস্টেন্স দেহ হলে তার থাকে ব্যাপ্তি আর মন হলে থাকে চিন্তা। ব্যাপ্তি ছাড়া যেমন দেহ হয় না তেমনি চিন্তা ছাড়া মন হয় না। ব্যাপ্তির জন্য স্থান লাগে, চিন্তার জন্য লাগে না। দেকার্ত সাবস্টেন্সের এই দুই প্রধান বৈশিষ্ট্যকে বলেছিলেন এট্রিবিউট, আর পরিবর্তনশীল অন্য সব বৈশিষ্ট্যকে বলেছিলেন এই দুই এট্রিবিউটের মোড। দেকার্তের গড এক অসীম চিন্তা-সাবস্টেন্স, অন্য সব চিন্তা-সাবস্টেন্স ও ব্যাপ্তি-সাবস্টেন্স যার সৃষ্টি। স্পিনোজা অসংখ্য সাবস্টেন্সের এই ধারণা বাতিল করে বলেছিলেন, সাবস্টেন্স একটাই, তার নাম গড।
স্পিনোজার সাবস্টেন্স অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না, অস্তিত্বের জন্যও না, ভাবনার জন্যও না। ব্যাপ্তি ও চিন্তা সাবস্টেন্সের এট্রিবিউট বা প্রধান বৈশিষ্ট্য। অস্তিত্বের দিক দিয়ে সাবস্টেন্স ও এট্রিবিউটের কোনো পার্থক্য নাই, দুইটা একই জিনিস, একসাথে থাকে। এট্রিবিউটহীন সাবস্টেন্স নাই, সাবস্টেন্সহীন এট্রিবিউট নাই। কিন্তু ভাবনার দিক দিয়ে এদের পার্থক্য আছে। আমরা সাবস্টেন্সকে তার এট্রিবিউট থেকে আলাদাভাবে ভাবতে পারি, যদিও তারা বাস্তবে এক। মোড হলো জেনারেল এট্রিবিউটের স্পেশাল এক্সপ্রেশন। মনের সব চিন্তা হলো আমার চিন্তা-এট্রিবিউটের মোড, সব কিছুর দেহ হলো ব্যাপ্তি-এট্রিবিউটের মোড। একটা এট্রিবিউটের অসংখ্য মোড থাকতে পারে। মোড হচ্ছে সাবস্টেন্স-এট্রিবিউটের বিরাজ করার নির্দিষ্ট ধরন। আমরা সাবস্টেন্সকে দ্রব্য, এট্রিবিউটকে গুণ, আর মোডকে রূপ বলতে পারি; এখন থেকে তাই বলব। অস্তিত্ব ও ভাবনা দুই দিক থেকেই রূপের আগে দ্রব্য-গুণ। প্রকৃতিতে দ্রব্য-গুণ-রূপ ছাড়া আর কিছু নাই। কারণ ছাড়া কোনো কার্য হয় না, আর যেকোনো কার্যের জ্ঞান মানেই তার কারণের জ্ঞান। নিখিলের সবকিছু খোদার কার্য, নিখিল জানা যাবে কেবল যদি তার কারণ খোদাকে জানা যায়। ‘এথিক্সের’ প্রথম খণ্ডের সব সংজ্ঞা, এক্সিয়ম ও প্রপজিশন আগে দেখা যাক।
নং | সংজ্ঞা |
---|---|
স১ | স্বকৃত তাকেই বলে যার এসেন্সের মধ্যে অস্তিত্ব আছে, যার স্বভাব শুধু অস্তিত্বশীল হিসেবেই ভাবা যায় |
স২ | নিজপ্রকারে সসীম তাই যাকে একই ধরনের অন্য কিছু দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় |
স৩ | দ্রব্য (সাবস্টেন্স) তাকেই বলে যা শুধু নিজের মধ্যে থাকে, যাকে শুধু নিজের মাধ্যমে ভাবা যায় |
স৪ | গুণ (এট্রিবিউট) তাই দ্রব্যের এসেন্স যা দিয়ে তৈরি বলে বুদ্ধি মনে করে |
স৫ | রূপ (মোড) হলো দ্রব্যের প্রকাশ, যা শুধু অন্যের মধ্যে থাকে, যাকে শুধু অন্যের মাধ্যমে ভাবা যায় |
স৬ | খোদা (গড) এক পরম অসীম সত্তা, এমন এক দ্রব্য যার গুণ অসংখ্য, যার প্রতিটি গুণ অসীম ও চিরন্তন এসেন্স প্রকাশ করে |
স৭ | স্বাধীন তাকেই বলে যা শুধু নিজের স্বভাবের আবশ্যিকতায় বিরাজ করে, যার সব কাজ নিজের মাধ্যমে নির্ধারিত; আবশ্যক তাকেই বলে যার অস্তিত্ব ও নির্দিষ্ট কাজ সব অন্যের মাধ্যমে নির্ধারিত |
স৮ | ইটার্নিটি মানে স্বয়ং অস্তিত্ব যদি ধরে নেয়া হয় অস্তিত্ব এক চিরন্তন সত্তা থেকে আবশ্যিকভাবে আসে |
নং | এক্সিয়ম |
---|---|
এ১ | যাকিছু আছে হয় তার নিজের মধ্যে আছে নয় অন্যের মধ্যে আছে |
এ২ | যাকে তার নিজের মাধ্যমে ভাবা যায় না তাকে অন্যের মাধ্যমে ভাবতে হয় |
এ৩ | একটা নির্দিষ্ট কারণ থেকে সব সময় একটা কার্য ঘটে, নির্দিষ্ট কোনো কারণ না থাকলে কোনো কার্য ঘটতে পারে না |
এ৪ | কার্যের জ্ঞান তার কারণের জ্ঞানের মধ্যে থাকে ও তার উপর নির্ভর করে |
এ৫ | যাদের মধ্যে কমন কিছু নাই তাদের একটিকে দিয়ে অন্যটিকে বুঝা যায় না |
এ৬ | একটা সত্য ধারণা যার ধারণা তার সাথে অবশ্যই মিলতে হবে |
এ৭ | যাকে অস্তিত্বহীন হিসেবে ভাবা যায় তার এসেন্সের মধ্যে অস্তিত্ব নাই |
নং | প্রপজিশন | প্রমাণ |
---|---|---|
প্র১ | দ্রব্য তার সব রূপের আগে | স৩, স৫ |
প্র২ | দুই দ্রব্যের গুণ আলাদা হলে তাদের মধ্যে কমন কিছু নাই | স৩ |
প্র৩ | দুয়ের মধ্যে কিছু কমন না থাকলে একে অপরের কারণ হতে পারে না | এ৫, এ৪ |
প্র৪ | দুইটা জিনিসকে আলাদা করা যায় হয় তাদের গুণের পার্থক্য দিয়ে নয় তাদের রূপের পার্থক্য দিয়ে | এ১, স৩, স৫, স৪ |
প্র৫ | মহাবিশ্বে একই স্বভাব বা গুণের দুই বা ততোধিক দ্রব্য থাকতে পারে না | প্র৪, প্র১, স৩, স৬, প্র৪ |
প্র৬ | এক দ্রব্য থেকে আরেক দ্রব্য তৈরি করা যায় না | প্র৫, প্র২, প্র৩ |
প্র৭ | অস্তিত্ব দ্রব্যের স্বভাবের মধ্যেই আছে | প্র৬, স১ |
প্র৮ | প্রত্যেক দ্রব্য অবশ্যই অসীম | প্র৫, স২, প্র৭ |
প্র৯ | যার বাস্তবতা যত বেশি তার গুণ তত বেশি | স৪ |
প্র১০ | একটা দ্রব্যের প্রতিটা গুণ শুধু সেই গুণের মাধ্যমেই ভাবা যায় | স৪, স৩, স৬ |
প্র১১ | খোদা, অর্থাৎ অসংখ্য গুণবিশিষ্ট দ্রব্য যার প্রতিটা গুণ চিরন্তন ও অসীম এসেন্স প্রকাশ করে, অবশ্যই আছেন | এ৭, প্র৭, প্র২ |
প্র১২ | দ্রব্যের এমন কোনো গুণ ভাবা সম্ভব না যা থেকে মনে হয় দ্রব্য বিভাজ্য | প্র৮, প্র৬, প্র৫, প্র২, স৪, প্র১০, প্র৭ |
প্র১৩ | পরম অসীম দ্রব্য অবিভাজ্য | প্র৫, প্র১১, প্র৮ |
প্র১৪ | খোদা ছাড়া আর কোনো দ্রব্য নাই বা ভাবা যায় না | স৬, প্র১১, প্র৫ |
প্র১৫ | যাই আছে খোদার মধ্যে আছে এবং খোদা ছাড়া কিছু ভাবা যায় না | প্র১৪, স৩, স৫, এ১ |
প্র১৬ | খোদার স্বভাব থেকে অসংখ্য রূপে অসংখ্য জিনিস অবশ্যই আসে | স৬ |
প্র১৭ | খোদা শুধু তার স্বভাবের সূত্র অনুযায়ী কাজ করেন, অন্য কিছু মেনে নয় | |
প্র১৮ | খোদা সবকিছুর অন্তর্নিহিত কারণ, বহির্ভূত কারণ না | |
প্র১৯ | খোদা চিরন্তন, মানে তার সব গুণ চিরন্তন | |
প্র২০ | খোদার অস্তিত্ব ও তার এসেন্স একই জিনিস | |
প্র২১ | খোদার যেকোনো গুণের পরম স্বভাব থেকে যা কিছু আসে সব অবশ্যই চিরন্তন ও অসীম | |
প্র২২ | খোদার কোনো গুণ থেকে যা আসে সব আবশ্যিক ও অসীম, যদি সেই গুণ আবশ্যিক ও অসীম রূপায়ণের মাধ্যমে রূপায়িত হয় | |
প্র২৩ | আবশ্যিক ও অসীম যত রূপ আছে সব হয় খোদার কোনো গুণের পরম স্বভাব থেকে এসেছে, নয় কোনো গুণের আবশ্যিক ও অসীম রূপায়ণ থেকে এসেছে | |
প্র২৪ | খোদার বানানো কোনো জিনিসের এসেন্সের মধ্যে অস্তিত্ব নাই | |
প্র২৫ | খোদা সবকিছুর শুধু অস্তিত্বের কার্যকরী কারণ না, এসেন্সেরও কার্যকরী কারণ | |
প্র২৬ | কোনো জিনিস নির্দিষ্ট কিছু করার জন্য নির্ধারিত মানেই সেই নির্ধারণটা করেছেন খোদা, খোদা যাকে নির্ধারিত করেন নাই সে নিজে নিজেকে কিছু করার জন্য নির্ধারিত করতে পারে না | |
প্র২৭ | খোদা যাকে নির্দিষ্ট কিছু করার জন্য নির্ধারিত করেছেন সে নিজেকে অনির্ধারিত করতে পারে না | |
প্র২৮ | যেকোনো সসীম ও নির্ধারিত জিনিস থাকে ও কিছু করে কারণ তার থাকা ও করা অন্য একটি সসীম ও নির্ধারিত জিনিস দিয়ে নির্ধারিত, এবং এই সসীম ও নির্ধারিত কারণ থাকে ও কিছু করে কারণ তার থাকা ও কিছু করা আরেকটি সসীম ও নির্ধারিত জিনিস দিয়ে নির্ধারিত, এবং এই দ্বিতীয় কারণও আরেকটা কিছু দিয়ে নির্ধারিত, এবং এই কার্যকারণ চেইনের কোনো শেষ নাই | |
প্র২৯ | প্রকৃতিতে আকস্মিক কিছু নাই, সবকিছু খোদায়ী স্বভাবের আবশ্যিকতা দিয়ে থাকা ও কিছু করার জন্য নির্ধারিত | |
প্র৩০ | সক্রিয় সসীম বুদ্ধি বা সক্রিয় অসীম বুদ্ধি ভাবতে পারে শুধু খোদার গুণ ও রূপ, আর কিছু না | |
প্র৩১ | কামনা করা, ভালোবাসা, বা অন্য যেকোনো কিছু করা সসীম বা অসীম সক্রিয় বুদ্ধি কেবল ‘সৃষ্ট’ প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত, ‘স্রষ্টা’ প্রকৃতির সাথে না | |
প্র৩২ | ইচ্ছা কোনো স্বাধীন কারণ নয়, কেবল এক আবশ্যিক কারণ | |
প্র৩৩ | সবকিছু যেমন আছে তার চেয়ে ভিন্ন কোনোভাবে খোদার মাধ্যমে তারা তৈরি হতে পারত না | |
প্র৩৪ | খোদার ক্ষমতাই তার এসেন্স | |
প্র৩৫ | খোদার ক্ষমতার মধ্যে আমরা যাকিছু ভাবতে পারি সব অবশ্যই আছে | |
প্র৩৬ | এমন কিছু নাই যার স্বভাব থেকে একটা প্রভাবের জন্ম হয় না |
প্রপোজিশন ১–৫এ স্পিনোজা প্রমাণ করেন যে একাধিক দ্রব্যের একই গুণ থাকতে পারে না। আমি ও আমার ভাই দুই জনই ভালো হতে পারি, মনে হতে পারে আমরা দুইটা দ্রব্য যাদের মধ্যে একটা কমন গুণ আছে, কিন্তু আসলে আমরা দ্রব্যও না আর ‘ভালো’ কোনো গুণও না। এখানে স্পিনোজার সাথে দ্বিমত করেছিলেন লাইবনিয। স্পিনোজার মতে দুই দ্রব্যের এক গুণ থাকতে পারে না কারণ সেক্ষেত্রে তাদেরকে আলাদা করা যাবে না। কিন্তু লাইবনিযের মতে কয়েকটা গুণ কমন থাকলেও দুইটা দ্রব্যকে আলাদা করা সম্ভব যদি তাদের মধ্যে অন্য কয়েকটা গুণ আনকমন থাকে। স্পিনোজা এক দিকে বলছেন এক দ্রব্যের অনেক গুণ থাকতে পারে, আরেক দিকে বলছেন দুইটা দ্রব্যের মধ্যে মাত্র একটা গুণ কমন পড়লেই আর তাদের আলাদা করা যাবে না। লাইবনিয এখানে ফেলাসি দেখেছিলেন। স্পিনোজা দেখেন নাই কারণ, আগেই বলেছি, দ্রব্য-গুণ স্পিনোজার কাছে অনেক কাছাকাছি, একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করা যায় না।
প্রপোজিশন ৬–১৪তে স্পিনোজা খোদার সংজ্ঞা ও আবশ্যিকতা দেখিয়েছেন। খোদা এক দ্রব্য, যার গুণ অসংখ্য, যার প্রতিটার এসেন্স অসীম ও চিরন্তন। অস্তিত্ব দ্রব্যের স্বভাব, কারণ দ্রব্য নিজের বাইরের অন্য কিছু দিয়ে তৈরি হতে পারে না। দ্রব্য স্বয়ম্ভূ। এই প্রমাণ সেন্ট আন্সেল্মের অন্টোলজিকেল প্রুফের মতোই। দ্রব্য যদি স্বয়ম্ভূ হয় তবে তাকে অসীম ও চিরন্তন হতেই হবে। অসীম দুই রকমের: নিজপ্রকারে অসীম ও পরম অসীম। গুণ কেবল নিজপ্রকারে অসীম, কারণ তার প্রকারের অন্য কোনো গুণ থাকতে পারে না যে তাকে সীমাবদ্ধ করবে। কিন্তু দ্রব্য পরম অসীম যে-কারণে তার অসীম সংখ্যক গুণ থাকতে পারে। কেউ নিজপ্রকারে অসীম হলেও তাকে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব না, কিন্তু সে ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকতে পারে। কিন্তু কেউ পরম অসীম হলে এমন কিছুই থাকতে পারে না যা তার গুণের বাইরে। দ্রব্য স্বয়ম্ভূ চিরন্তন অসীম, খোদা দ্রব্য, সুতরাং খোদা আছেন। খোদা ছাড়া আর কোনো দ্রব্য থাকলে তা হয় খোদার বাইরে থাকবে নয় ভিতরে থাকবে। বাইরে থাকতে পারে না কারণ সম্ভাব্য সব গুণ খোদায়ী দ্রব্যের অংশ। ভিতরে থাকতে পারত যদি খোদায়ী দ্রব্য বিভাজ্য হতো। কিন্তু খোদার প্রতিটা দ্রব্যগুণ অবিভাজ্য, বিভাজ্য হলে এক গুণ দিয়ে আরেক গুণকে সীমাবদ্ধ করা যেত যা অসম্ভব। অতএব খোদার বাইরে বা ভিতরে কোথাও আর কোনো দ্রব্য নাই। অতএব খোদা ছাড়া আর কোনো দ্রব্য নাই, আর কোনো দ্রব্য ভাবা যায় না। যদি পারো তো খোদা ছাড়া আরেকটা দ্রব্য কল্পনা করো, দেখবে তোমার কল্পনার দ্রব্যটাই খোদা।
খোদার তিনটা আলাদা আলাদা প্রমাণ প্রপোজিশন ১১’র সাথে ছিল। প্রথমটা উপরেই বলা হয়েছে যা আন্সেল্মের প্রুফের মতো, এখানে খোদাকে দ্রব্যের প্রতিশব্দ হিসাবে ইউজ করলেই হয়। প্রথম প্রমাণ থাকার কারণ প্রতিষ্ঠা করে, দ্বিতীয় প্রমাণে না-থাকা নিয়ে চিন্তা করা হয়। একটা জিনিস না-থাকার কারণ হয় তার ভিতরে থাকবে নয় তার বাইরে থাকবে। খোদার ভিতরে তার না-থাকার কারণ থাকতে পারে না কারণ খোদা দ্রব্য, অস্তিত্ব যার স্বভাব। বাইরে যদি থাকে তবে তা হয় খোদার মতো হবে নয় আলাদা হবে। মতো হলে খোদার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। আলাদা হলে তা খোদার অস্তিত্ব ঠেকাতে পারবে না, কারণ এক ধরনের জিনিস অন্য ধরনের জিনিসের কারণ হতে পারে না। তৃতীয় প্রমাণে ধরে নেয়া হয় থাকা এক ধরনের ক্ষমতা, না-থাকা এক ধরনের অক্ষমতা। আমাদের মতো সসীম জিনিসেরই থাকার ক্ষমতা আছে, অতএব পরম অসীম খোদার থাকার অক্ষমতা থাকতেই পারে না, খোদার থাকার ক্ষমতা আছে কারণ তিনি আমাদের চেয়ে বড়।
খোদার অসংখ্য গুণের দুইটা ব্যাপ্তি ও চিন্তার রূপ দিয়ে আমাদের পুরা বাস্তবতা তৈরি। রূপ হলো গুণের বহিঃপ্রকাশ আর গুণ দ্রব্যের অবিচ্ছেদ্য ধর্ম। তাহলে সব রূপও খোদার অংশ। কিন্তু কেমন অংশ? আমি কি খোদার অংশ? যে ল্যাপ্টপ দিয়ে লিখছি তাও খোদার অংশ? আমার মনের সব কল্পনাও খোদার খেয়াল? প্রকৃতি দুই ধরনের, স্রষ্টা প্রকৃতি ও সৃষ্ট প্রকৃতি, স্পিনোজার মতে দুইটাই খোদা। খোদা একইসাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টি। খোদা প্রকৃতি এবং প্রকৃতির কারণ, একইসাথে কার্য ও কারণ। কোনো কার্যের কারণ চার ধরনের হয়: ফিজিকেল ফর্মাল কার্যকর ও ফাইনাল। রেস্টুরেন্টে কুকের রান্নার উদাহরণ দিয়ে চারটা পরিষ্কার করা যায়। খাবারের উপকরণ হলো ফিজিকেল কারণ, রেসিপি ফর্মাল কারণ, কুক নিজে কার্যকর কারণ, আর কাস্টমাররা ফাইনাল কারণ। খোদা একইসাথে প্রকৃতি ও প্রকৃতির চার কারণ, গোটা প্রকৃতির, শুধু ব্যাপ্তিচিন্তা দিয়ে প্রকাশিত আমাদের প্রকৃতির না। ব্যাপ্তিচিন্তার বাইরেও প্রকৃতির (খোদার) আরো অসীম সংখ্যক গুণ আছে, এবং প্রত্যেক গুণের আছে অগণিত রূপ। এক রকমের সব রূপের সমষ্টি হলো একটা বাস্তবতা। আমাদের বাস্তবতার সব পদার্থ খোদার অংশ (ফিজিকেল কারণ), সব গাণিতিক সূত্র নীতি বা তথ্য খোদার অংশ (ফর্মাল কারণ), স্রষ্টাও খোদা (কার্যকর কারণ), চূড়ান্ত লক্ষ্যও খোদা (ফাইনাল কারণ)। কাচের দেয়ালে পাথর মারলে কাচ ভেঙে যায়, এখানে ভাঙার কার্যকর কারণ পাথর, কার্যকর কারণ ঘটনার অংশ হয় না, বাইরে থেকে ঘটনা ঘটায়, যেমন রাঁধুনি তার রান্নার অংশ না। কিন্তু খোদা প্রকৃতির মাঝে অন্তর্নিহিত, ফিজিকেল ও ফর্মাল কারণও খোদা, তিনি প্রকৃতির বহির্ভূত কারণ না।
ফিজিক্স আমাদের বিশ্বের যে স্টেম (স্পেস-টাইম-এনার্জি-ম্যাটার) নিয়ে কাজ করে তার ফিজিকেল কারণ খোদা, স্টেম খোদা দিয়ে তৈরি, আবার এই সবকিছুর ফর্মাল কারণও (ফিজিক্সের সব সূত্র) খোদা। কার্যকর ও ফাইনাল কারণ বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। সবকিছু কিভাবে খোদা হয়? রূপের মাধ্যমে। সবকিছুই রূপ, রূপ গুণের প্রকাশ, গুণ দ্রব্যের ধর্ম, দ্রব্যই খোদা। সুতরাং সব রূপ, বাস্তবতার সবকিছু খোদার ব্যক্তি। আমাদের বাস্তবতা তিন ধরনের: ফিজিকেল ফর্মাল ও মেন্টাল। সব স্টেম ফিজিকেল, গণিত তথ্য গণনা ও যুক্তির বাস্তবতা ফর্মাল, আর চেতনা ও মানসিক বাস্তবতা মেন্টাল। ফিজিকেল ও ফর্মাল বাস্তবতা ব্যাপ্তিগুণের রূপ, মেন্টাল বাস্তবতা চিন্তাগুণের রূপ।
রেফারেন্স
- স্টিভেন ন্যাডলার, স্পিনোজা’স এথিক্স: এন ইন্ট্রোডাকশন, কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৬।
- বেথ লর্ড, স্পিনোজা’স এথিক্স: এন এডিনব্রা ফিলোসফিকেল গাইড, এডিনব্রা ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১০।
- স্পিনোজা, অনু. স্যামুয়েল শার্লি, স্পিনোজা: কমপ্লিট ওয়ার্কস, হ্যাকেট পাব্লিশিং কোম্পানি, ২০০২।