Abekta

Nothing human is alien to me

User Tools

Site Tools


This is an old revision of the document!


আলমাজেস্ট থেকে রেভলুশনস

গ্রিক এস্ট্রোনমার টলেমির আলমাজেস্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৪৫ সালের দিকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়, আর পোল্যান্ডের পাদ্রি কোপার্নিকাসের অন দ্য রেভলুশনস (আমরা এখানে শুধু ‘রেভলুশনস’ ডাকব) প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৪৩ সালে জার্মানির নুরেমবার্গ থেকে। টলেমির বিশাল সিন্থেসিস সম্ভব হয়েছিল তার আগের দুই হাজার বছর ধরে ইরাক সিরিয়া ও গ্রিসে চলতে থাকা সিস্টেমেটিক অব্জার্ভেশনের কারণে। কোপার্নিকাসের বিরাট এনালাইসিস সম্ভব হয়েছিল তার আগের দেড় হাজার বছর ধরে ভারত চীন ইউরোপ ও ইসলামি বিশ্বে চলতে থাকা সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের কারণে। এস্ট্রোনমির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে এই দুই বইয়ের জায়গা অনেক উপরে, কারণ এদের সামাজিক প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। কোপার্নিকাসের বইয়ের নাম ‘রেভলুশনস’ ছিল বলেই হয়ত ‘রেভলুশন’ মানে আজ হয়ে গেছে বিপ্লব, কোপার্নিকাসের ‘রেভলুশনস’ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। এই আর্টিকেলে আমরা দেখব ‘আলমাজেস্ট’ থেকে ‘রেভলুশনস’ পর্যন্ত মানুষ কিভাবে মহাবিশ্বের একটা “কাজের মডেল” তৈরির চেষ্টা করেছে এবং ‘রেভলুশনসের’ মডেল শেষ পর্যন্ত কিভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

1. এনুমা আনু এনলিল

আলমাজেস্টের কাহিনি শুরু করতে হবে আরেকটা বই থেকে: ইরাকের ব্যাবিলনে যিশুর এক হাজার বছর আগে লেখা এস্ট্রোলজির বই ‘এনুমা আনু এনলিল’ (যখন আনু ও এনলিল)। এতে ইরাকি এস্ট্রোনমির প্রায় দুই হাজার বছরের ঐতিহ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘এনুমা’ ওমেন, মানে অশনি সংকেতের বই। গ্রিকদের মতো ব্যাবিলনিয়ানদের এস্ট্রোলজির বিষয় মানুষের ভাগ্য আবিষ্কার ছিল না, তাদের মাথাব্যথা ছিল ওমেন নিয়ে। আকাশে তারা এমন কিছু নিয়মিত ঘটনা চিহ্নিত করতে পেরেছিল যাদেরকে ওমেন হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। এসব ওমেন আগে থেকে বুঝতে পারলে, মানে প্রেডিক্ট করতে পারলে, সঠিক পূজা ও আচারের মাধ্যমে খারাপ ভবিষ্যৎ ঠেকানো সম্ভব বলে তারা বিশ্বাস করত।

‘এনুমা’র লেখকরা অন্তত সাত শতাব্দী ধরে স্থির তারাদের সাপেক্ষে চাঁদ সূর্য ও পাঁচটি গ্রহের গতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল বলেই প্রথম কসমোলজিকেল মডেল বানানো গিয়েছিল, আলমাজেস্ট যার চূড়ান্ত পরিণতি। চাঁদের বারো মাসের (৩৫৪ দিন) সাথে সূর্যের এক বছর (৩৬৫ দিন) মিলানো নিয়ে চিন্তিত ছিল তারা। যিশুর ছয়শ বছর আগে ব্যাবিলনিয়ানরা মেটনিক সাইকেলের খোঁজ পেয়েছিল, মানে বুঝতে পেরেছিল চাঁদের ২৩৫ মাস (২৯.৫ দিন করে মোট ৬৯৩২ দিন) সূর্যের ১৯ বছরের (৩৬৫.২ দিন করে মোট ৬৯৩৮ দিন) প্রায় সমান। আর ১৯ বছরে যেহেতু ২২৮ মাস হয় (যা ২৩৫ থেকে ৭ মাস কম) সেহেতু ১৯ বছরের মধ্যে মোট ৭টা মাস যোগ করতে হবে, মানে ১২ বছর হবে বারো মাসের, আর ৭ বছর হবে তের মাসের।

চাঁদ সূর্য গ্রহের অতীত ও ভবিষ্যৎ অবস্থানের তালিকা হিসেবে এফেমেরিস তৈরি করা ব্যাবিলনেই শুরু হয়েছিল। এজন্য এঙ্গুলার পজিশনের পাশাপাশি তারা বেগ মাপাও শুরু করেছিল। যেমন, উপরে খ্রিস্টপূর্ব ১৩২ সালের একটি ব্যাবিলনিয়ান ট্যাবলেটের ডেটার উপর ভিত্তি করে এক বছরে সূর্যের কৌণিক বেগের পরিবর্তন দেখানো হয়েছে। পটভূমির “স্থির” তারাদের সাপেক্ষে সূর্য বছরে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে। এই যাত্রায় সে মাসে কতটুকু যায় তাই দেখানো হয়েছে বেগ হিসাবে। দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় মাসে সূর্যের কৌণিক বেগ কমতে কমতে মিনিমাম (প্রায় ২৮ ডিগ্রি/মাস) হয়, এবং তারপর বাড়তে বাড়তে অষ্টম মাসে ম্যাক্সিমাম (৩০ ডিগ্রি/মাস) হয়। ছয় মাস ধরে বেগ কমে, ছয় মাস ধরে বাড়ে।

বেগ ঠিক কিভাবে পাল্টায় তা ব্যাখ্যা করার জন্য তাদের দুইটা মেথড ছিল। এক মেথডে ধরে নেয়া হতো সূর্যের বেগ অর্ধেক বছর কনস্টেন্ট থাকে, তারপর শুধু একবার পাল্টায় এবং পরের অর্ধেক বছর আবার কনস্টেন্ট থাকে। অন্য মেথডে বলা হতো, সূর্যের বেগ অর্ধেক বছর ধরে সমান হারে বাড়তে থাকে, এবং পরের অর্ধেক বছর আবার সমান হারে কমতে থাকে। সরণ বেগ ও ত্বরণের হিসাব মানুষ প্রথম সূর্যের উপরই ভালোভাবে প্রয়োগ করেছিল। একইভাবে চাঁদ ও খালিচোখে দৃশ্যমান পাঁচটি গ্রহের সরণ বেগ ও ত্বরণও এনুমা’র লেখকরা হিসাব করেছিল, তবে এর উপর ভিত্তি করে একটা কসমোলজি, মানে মহাবিশ্বের একটা পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরি হয়েছিল গ্রিসে।

2. এরিথমেটিক থেকে জিওমেট্রি

ব্যাবিলনিয়া’র জ্যোতির্বিদরা এরিথমেটিকের উপর যত গুরুত্ব দিয়েছিল গ্রিকরা তত গুরুত্ব দিয়েছিল জিওমেট্রির উপর। চাঁদ সূর্য ও গ্রহগুলো যেহেতু আসলেই জ্যামিতিক পথ অনুসরণ করে সেহেতু গ্রিকদের প্রেডিকশন ছিল আরো সহজ, আরো নিখুঁত। এবং সব ডেটা বিশ্লেষণ করে গ্রিকরা মহাবিশ্বের একটা পৃথিবীকেন্দ্রিক (জিওসেন্ট্রিক) মডেল তৈরি করেছিল। এই মডেলে প্রথম বড় অবদান রেখেছে তুরস্কের মাইলিটাস শহরের গ্রিক দার্শনিক এনাক্সিমেন্ডার। তার মতে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থিরভাবে বসানো একটা সিলিন্ডার যার একটা সমান তলে মানুষ থাকে; একে ঘিরে আকাশের সবকিছু ঘুরছে; সবচেয়ে দূরে, সবার বাইরে সূর্য, তারপর চাঁদ, তারপর সব তারা, এবং পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে পাঁচটি গ্রহ।

পিথাগোরাসের অনুসারীরা প্রথম ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল যে পৃথিবী একটা গোলক (স্ফিয়ার), সিলিন্ডার বা অন্য কোনো আকৃতির না। এরিস্টটল চন্দ্রগ্রহণের মাধ্যমে এর প্রমাণ সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছে। এই এক্লিপ্সের সময় পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর দিয়ে যায়, এবং ছায়ার চলমান প্রান্তটা থাকে গোল, পৃথিবী গোল হলেই কেবল এটা সম্ভব।

প্লেটো-এরিস্টটলের সময় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল যে গোল পৃথিবীর চারদিকে সাতটা ভ্রাম্যমাণ প্ল্যানেট আছে (চাঁদ সূর্য বুধ শুক্র মঙ্গল বৃহস্পতি শনি), আর এই সবকিছু ঘিরে রেখেছে একটা বিশাল গোলক যার মধ্যে সব তারা আটকানো; একে আমরা তারাগোলক বলতে পারি। তারাগোলক এবং সব প্ল্যানেট পৃথিবীর চারদিকে ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরে। তারাগোলকের এছাড়া আর কোনো গতি নাই, এই গোলকের একটা তারার সাপেক্ষে অন্য কোনো তারার পজিশন কখনো পাল্টায় না। কিন্তু প্ল্যানেটরা তারাগোলকের সাপেক্ষে সারা বছর ধরে বিভিন্ন বেগে ঘুরে। গ্রহ পাঁচটা আবার মাঝে মাঝে যাত্রাপথে থেমে কিছুদিন উল্টা দিকে চলার পর আবার সামনে যেতে শুরু করে।

প্লেটো সাতটা প্ল্যানেটের গতি, বিশেষ করে পাঁচটা গ্রহের অদ্ভুত উল্টাগতি মানতে পারেনি। সে তার স্টুডেন্টদের এটা প্রমাণ করার দায়িত্ব দিয়েছিল যে প্ল্যানেটদের গতিও ইউনিফর্ম (স্পিড কনস্টেন্ট) ও সার্কুলার (বৃত্তাকার)। আর এই প্রমাণ প্রথম করার চেষ্টা করেছিল তুরস্কের নাইডাস শহরের ইউডক্সাস। তার মডেল উপরের এনিমেশনে দেখানো হয়েছে। গ্রহটা লাল গোলকের ইকুয়েটর বরাবর ঘুরছে, আর এই গোলকের দুই মেরু থেকে বের হওয়া দুটি দণ্ড বাইরের সবুজ গোলকের সাথে আটকানো। দুই গোলকই ঘুরছে, দুয়ের কেন্দ্র এক, তবে বেগ আলাদা ও রোটেশনের এক্সিস আলাদা। এর ফলে গ্রহটা ইংলিশ ‘এইট’ নাম্বারের মতো একটা পথে ঘুরে এবং এর ফলেই পৃথিবী থেকে মাঝেমাঝে মনে হয় গ্রহটা উল্টা দিকে যাচ্ছে। এইটের মতো এই গতিপথ ঘোড়ার খুরে লাগানো ‘হিপোপিডের’ মতো হওয়ায় এর নাম দেয়া হয়েছিল হিপোপিড মডেল। প্রত্যেক গ্রহের জন্য এর বাইরে আরো দুটি করে গোলক কল্পনা করতে হতো, একটা আহ্নিক গতির জন্য, আরেকটা বার্ষিক গতির জন্য। প্রত্যেক গ্রহের চারটা করে মোট কুড়িটা গোলক, চাঁদ ও সূর্যের জন্য তিনটা করে, আর তারাগোলকের জন্য একটা, এই মোট ২৭টা গোলকের এক অদ্ভুত সিস্টেম এটা। তবে এখানে প্লেটোর মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে, সবকিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে ইউনিফর্ম সার্কুলার মোশন (ইউসিএম) দিয়ে।

বাস্তববাদী এরস্টটল এই গাণিতিক মডেল মানতে পারেনি। সে সব গোলক বাদ দিয়ে প্রথমে উপরে দেখানো ৮ গোলক চিন্তা করে। সবার বাইরে তারাগোলক (৮ নম্বর), যার চব্বিশ ঘণ্টার আহ্নিক গতি ভিতরের সব গোলকের মধ্যে সঞ্চালিত হয়, সুতরাং আহ্নিক গতির জন্য আর কোনো গোলক লাগে না। পজিশন ও আহ্নিক গতির জন্য আটটা গোলকই (সাতটা প্ল্যানেটের গোলক ও একটা তারাগোলক) যথেষ্ট, কিন্তু বার্ষিক গতি ও উল্টাগতির জন্য প্রত্যেক প্ল্যানেটের গোলকের ভিতরে আরো গোলকের দরকার হয়েছিল। তাই এরিস্টটলও আরো অনেক গোলক যোগ করেছিল, তবে প্লেটো ও ইউডক্সাসের মতো সে কেবল গণিতের খাতিরে কিছু যোগ করতে রাজি ছিল না, তাই যোগ করেছিল যা সে আসলেই ফিজিকেলি বাস্তব মনে করত।

এস্ট্রোনমারদের জন্য দার্শনিকদের এই আদর্শ সিস্টেম একটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল, তা হোক প্লেটোর মতো জ্যামিতিক বা এরিস্টটলের মতো ফিজিকেল সিস্টেম। কারণ এস্ট্রোনমারদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল নিখুঁত প্রেডিকশন, নির্দিষ্ট কোনো মডেল দিয়েই যা তখন করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া বৃত্ত দিয়ে সব ব্যাখ্যা করলে প্ল্যানেটদের উজ্জ্বলতা ও আকার কেন বদলায় তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। চাঁদ ও সূর্য কখনো বড় দেখায়, কখনো ছোট। পাঁচ গ্রহের উজ্জ্বলতা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। এসবের একমাত্র কারণ হতে পারে পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্বের পরিবর্তন। কিন্তু কক্ষপথ বৃত্তাকার হলে দূরত্ব কখনো পাল্টাতে পারে না।

3. জিওমেট্রি থেকে এরিথমেটিক

এসব সমস্যার কারণে হেলেনিক যুগের (এরিস্টটলের পরের) গ্রিক এস্ট্রোনমাররা জ্যামিতিক সিস্টেম থেকে আবার ব্যাবিলনিয়ার এরিথমেটিক হিসাবের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করে। এস্ট্রোনমিতে প্রায়োগিকতা ও প্রেডিক্টেবিলিটি সবার আগে। জ্যামিতিনির্ভর মডেলের চেয়ে শুধু অব্জার্ভেশন থেকে পাওয়া ডেটা বেশি কাজের। এই কারণেই এরিস্টার্কাসের সূর্যকেন্দ্রিক (হেলিওসেন্ট্রিক) মডেলও গ্রিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। এরিস্টার্কাস মনে করত পৃথিবী ও অন্য সব গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, তবে এই ঘোরার কারণে স্থির তারাদের আপাত পজিশন পাল্টায় না কারণ পৃথিবীর অর্বিটের সাইজের তুলনায় তারাদের দূরত্ব অনেক বেশি। এসব কথাই দেড় হাজার বছর পর কোপার্নিকাস বলবে, কিন্তু তখন গ্রিকদের দরকার ছিল আরো ভালো অব্জার্ভেশন ও প্রেডিকশন, মডেলের দিকে তারা মনোযোগ দেয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে একজন ব্যাবিলনিয়ানই (সেলুকাস) এরিস্টার্কাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেল বিশ্বাস ও প্রমাণের চেষ্টা করেছিল।

ইউডক্সাসের গোলক গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও এরিস্টটলের জিওসেন্ট্রিক মডেল থেকে এস্ট্রোনমাররা কাজ শুরু করেছিল এবং প্লেটোর ইউসিএম ফেলে দেয়ার সাহসও তাদের হয়নি। যিশুর দুইশ বছরের মতো আগে এপোলোনিয়াস জিওসেন্ট্রিক মডেল দিয়ে সাত প্ল্যানেটের সব ধরনের গতি ব্যাখ্যা করার জন্য দুইটা নতুন চাল চালে। প্রথমত, সব প্ল্যানেটের অর্বিট বৃত্তাকার রাখলেও বৃত্তের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীকে একটু দূরে সরিয়ে দেয়, এই নতুন এক্সেন্ট্রিক সার্কেলের নাম হয় ডেফারেন্ট; এতে প্ল্যানেটদের বেগ ও আকারের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়। দ্বিতীয়ত, প্ল্যানেটগুলোকে ডেফারেন্টে সরাসরি না ঘুরিয়ে এপিসাইকেল নামে আরেকটা বৃত্তের উপর বসায়, এবং এপিসাইকেলের কেন্দ্রকে বসায় ডেফারেন্টের উপর; প্ল্যানেট এপিসাইকেলে ঘুরে, আর এপিসাইকেলের কেন্দ্র ডেফারেন্টে ঘুরে। এর মাধ্যমে উল্টাগতি ব্যাখ্যা করা যায়। কিভাবে তা নিচের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে।


প্ল্যানেটের বেগ যদি এপিসাইকেলের চেয়ে যথেষ্ট বেশি হয় তাহলে প্ল্যানেট যখন ডেফারেন্টের ভিতরে চলে আসে তখন কিছুটা সময় পৃথিবী থেকে মনে হবে সে উল্টা দিকে যাচ্ছে। এপোলোনিয়াস মডেল বানালেও তা ইউজ করে সব প্ল্যানেটের গতি আসলেই হিসাব করেছিল কি না আমরা জানি না, কারণ তার কোনো লেখা আমাদের হাতে আসেনি। কিন্তু তার পরের প্রজন্মে হিপার্কাস ঠিক এই কাজটাই করেছিল। হিপার্কাসের মাধ্যমেই গ্রিকদের জ্যামিতিক মডেল ব্যাবিলনিয়ান অব্জার্ভেশনের সুফল পেতে শুরু করেছিল। হিপার্কাস চাঁদের অর্বিট মডেল করার জন্য এপিসাইকেল ও ডেফারেন্ট ব্যবহার করেছিল, কিন্তু প্রতিটা বৃত্তের সাইজ ও বেগের প্যারামিটার নির্ধারণ করেছিল ব্যাবিলনিয়ানদের করা এক্লিপ্সের রেকর্ড ইউজ করে।

এপোলোনিয়াসের জিওমেট্রির সাথে ব্যাবিলনিয়ার এরিথমেটিক হিপার্কাস কি যত্নের সাথে মিলিয়েছিল তা একটা উদাহরণ দিলেই বুঝা যাবে। ব্যাবিলনিয়ান রেকর্ড থেকে হিপার্কাস জানত যে ১,২৬,০০৭ দিন ১ ঘন্টায় মোট ৪,২৬৭টা সাইনডিক মাস থাকে, এবং এর মধ্যে চাঁদ মোট ৪,৫৭৩ বার একই বেগে ফিরে আসে, আর ৪,৬১২ বার এক্লিপ্টিকের একই বিন্দুতে ফিরে আসে। এক লাখ দিনের ডেটা যাদের হাতে ছিল তাদের আকাশ মাপার হেরিটেজ অনেক বড় বলতেই হবে। তবে হিপার্কাস থেকে টলেমি পর্যন্ত প্রায় তিনশ বছর গ্রিক বিশ্বে আর বড় কোনো কাজ হয়েছে বলে জানা যায়নি। সেই সময় ভারতে অনেক কাজ হয়েছে। আলেকজান্ডারের কারণে পশ্চিম ভারত ও গ্রিস-ম্যাসিডোনিয়ার মধ্যে একটা যোগাযোগও শুরু হয়েছিল।

টলেমি ১৫০ সালের দিকে ‘ম্যাথেমেটিকেল কম্পাইলেশন’ নামে একটা বই প্রকাশ করেছিলেন যা মধ্যযুগের মুসলমানদের কারণে বর্তমানে ‘আলমাজেস্ট’ (আল মাজিস্তি: দ্য গ্রেটেস্ট) নামে পরিচিত। এই বইয়ে এপোলোনিয়াস ও হিপার্কাসের সব কাজ সিন্থেসাইজ করে সবগুলো প্ল্যানেটের গতির (চাঁদ সূর্য সহ) প্রেডিকশনক্ষম মডেল বানানো হয়েছিল। এসব মডেলে টলেমির কিছু মৌলিক কাজও আছে। যেমন, টলেমিই প্রথম ‘ইকুয়েন্ট’ নামে একটা বিন্দু যোগ করে (উপরের ছবিতে দেখানো আছে)। এক্সেন্ট্রিক সার্কেলের কেন্দ্র থেকে পৃথিবী যত দূরে তার ঠিক উল্টা দিকে ঠিক তত দূরে ইকুয়েন্ট। একটা প্ল্যানেটের বেগ অর্বিটে এমন হতে হবে যাতে ইকুয়েন্টের সাপেক্ষে তার আপাত বেগ সব সময় সমান হয়। প্লেটোর ইউসিএম রক্ষার জন্যই এই সুষম বেগের দরকার ছিল। প্ল্যানেট ইকুয়েন্ট থেকে দূরে থাকলে আস্তে চলবে, কাছে থাকলে জোরে চলবে, তাই আপাত কৌণিক বেগ কখনো পাল্টাবে না। মধ্যযুগে ইসলামি বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ইকুয়েন্ট নামের এই আজগুবি বিন্দু নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন।

এই বইয়েই প্রথম পৃথিবী থেকে চাঁদ সূর্য গ্রহ ও তারাদের দূরত্বের ক্রম ঠিক করার কথা বলা হয়েছে। তারাগোলক যে সবচেয়ে দূরে, সবার বাইরে, তা এরিস্টটল ও ইউডক্সাস টলেমির পাঁচশ বছর আগেই বলেছিল, টলেমি তা পাল্টায়নি। আর সাত প্ল্যানেটের অবস্থান সে ঠিক করেছে তাদের পিরিয়ডের উপর ভিত্তি করে। যে যত বেশি দিনে পৃথিবীকে একবার আবর্তন করে সে তারাগোলকের তত কাছাকাছি। এই হিসাবে তারাগোলকের পরেই আসে শনি (পিরিয়ড ২১ বছর), তারপর বৃহস্পতি (১২ বছর) ও মঙ্গল (২ বছর)। আর সবচেয়ে কাছে বসানো হয় চাঁদকে, কারণ তার পিরিয়ড মাত্র ২৯ দিন। আরো তিনটা প্ল্যানেট রয়ে যায়: সূর্য, বুধ ও শুক্র। এদের ক্রম ঠিক করা কঠিন ছিল কারণ এরা সব সময় কাছাকাছি থাকে এবং সবাই মোটামুটি ১ বছরে পৃথিবীকে একবার আবর্তন করে বলে মনে হয়। টলেমি সূর্যকে ঠিক মাঝখানে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তার উপরে মঙ্গল বৃহস্পতি শনি, আর নিচে শুক্র বুধ চাঁদ। কেন শুক্র আগে আর বুধ পরে তার কোনো যুক্তি ছিল না।

টলেমির আরেকটা বড় অবদান ছিল প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বের সাইজ মাপা। সে চিন্তা করেছিল এক প্ল্যানেটের গোলক থেকে তার পরের প্ল্যানেটের গোলকের মধ্যে কোনো ফাঁক নাই। অতএব প্রত্যেক গোলকের পুরুত্ব হিসাব করে সে পৃথিবী থেকে তারাগোলক পর্যন্ত মোট দূরত্ব পেয়েছিল পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ১৯,৮৬৫ গুণ, মানে ১২১ মিলিয়ন কিলোমিটার। এটাই ছিল তার মতে কসমসের সাইজ। এই সংখ্যা পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের (১৫০ মিলিয়ন কিমি) চেয়েও কম। তবুও টলেমির কাজকে গুরুত্ব দিতে হবে। টলেমিই প্রথম দেখিয়েছিল মহাবিশ্বের সাইজ আমাদের পরিচিত পার্থিব সবকিছুর তুলনায় কত অবিশ্বাস্য রকমের বেশি হতে পারে।

4. কিমেরা ও কোপার্নিকাস

পোলিশ পাদ্রি কোপার্নিকাস পড়াশোনা করেছিল রেনেসাঁর ইতালিতে, ১৫০০ সালে রোমে এস্ট্রোনমি নিয়ে লেকচারও দিয়েছিল। প্রাচীন গ্রিক ও আধুনিক (তখনকার প্রেক্ষাপটে) ইসলামি অনেক বিদ্যা পড়েই সে বড় হয়েছে। আলমাজেস্টের নিখুঁত প্রেডিকশনক্ষম সিস্টেম নিয়ে তার মেইন সমস্যা ছিল, এটা কিমেরার মতো। এক জন্তুর হাত, আরেক জন্তুর পা, এভাবে একেক জন্তু থেকে একেক অঙ্গ নিয়ে জোড়া দেয়ার পর যে কিম্ভূতকিমাকার জিনিস তৈরি হয় মিথে তার নাম কিমেরা। কোপার্নিকাসের মতে টলেমির সিস্টেমও তেমন, এর কোনো একক ব্যাখ্যা নাই, একেক প্ল্যানেটের গতি একেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এর ফলে প্রেডিকশন ভালো হয়, কিন্তু ইউনিভার্স হয়ে যায় কিম্ভূত কিমেরা।

এই কিমেরা ধ্বংস করে মহাবিশ্বের একটা “সুন্দর” মডেল বানানোর জন্য কোপার্নিকাস সাহস পেয়েছিল প্রাচীন গ্রিক ও আধুনিক মুসলমানদের কাছ থেকে। প্রাচীন গ্রিক অনেক দার্শনিক মনে করত পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এর একটা বড় আলামত ছিল এই যে, পাঁচটা গ্রহের গতির মধ্যেই সূর্যের গতি নিহিত আছে; প্রতিটা গ্রহের পিরিয়ডই “বছরের” গুণিতক হিসাবে মাপা যায়, যে বছর আসলে সূর্যের পিরিয়ড। ইকুয়েন্ট নিয়ে মুসলমানদের সমালোচনাও কোপার্নিকাস জানত। তার সূর্যকেন্দ্রিক কসমোলজিকেল মডেলের একটা ছোট পরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৩৯ সালে, কিন্তু ‘অন দ্য রেভলুশনস অফ দ্য হেভেনলি স্ফিয়ারস’ (সংক্ষেপে ‘রেভলুশনস’ বা ‘অন দ্য রেভলুশনস’) নামে পুরো বইটা প্রকাশিত হয় ১৫৪৩ সালে, যে বছর সে মারা যায়।

49174363033_bc2d3ef8cd_b.jpg

‘রেভলুশনস’ বইয়ে মহাবিশ্বের এই ছবি তুলে ধরা হয়। বাইরে থেকে ভিতরের দিকে যথাক্রমে তারাগোলক, স্যাটার্ন, জুপিটার (জোভ), মার্স, আর্থ (টেরা) ও মুন (লুনা), ভেনাস, মার্কারি, আর সবার মাঝখানে সান (সল)। আলমাজেস্টের মডেলে পৃথিবী ও সূর্যের জায়গা বদল কয়ে দেয়ার সাথেসাথে একটা বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আগে কেউ বুঝতে পারত না, মার্স জুপিটার ও স্যাটার্নের পিরিয়ড বেশি হলেও, ভেনাস ও মার্কারির পিরিয়ড কেন সূর্যের মতোই ১ বছর। ‘রেভলুশনসের’ মডেলে এর কারণটা খুব পরিষ্কার। পৃথিবী পাঁচটা গ্রহকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে, বাইরে তিনটা ভিতরে দুইটা। বুধ ও শুক্র পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে হওয়ায় আমাদের কাছে মনে হয়, সূর্যের সাথে এই দুই গ্রহকেও ১ বছরে একবার করে আবর্তন করছে। পৃথিবীর পিরিয়ড বাদ দিয়ে কোপার্নিকাস সূর্যের চারদিকে ভেনাস (৭ মাস) ও মার্কারির (৮০ দিন) আসল পিরিয়ড মাপতে পেরেছিল। এর ফলে পিরিয়ডের মাধ্যমে ছয়টা গ্রহের (পৃথিবী সহ) সিরিয়াল ঠিক করাতে আর কোনো সমস্যা ছিল না। পৃথিবীর পিরিয়ড সব গ্রহের হিসাব থেকে বাদ দেয়ার পর সূর্য থেকে প্রত্যেক গ্রহের আপেক্ষিক দূরত্বও মাপা সম্ভব হয়েছিল। তবে কোপার্নিকাস এটাও বুঝেছিল যে, জিওসেন্ট্রিক ও হেলিওসেন্ট্রিক মডেল মহাবিশ্বকে সমানভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে; দুইটার প্রেডিক্টিভ পাওয়ারই সেই সময় সমান ছিল।

কোপার্নিকাসের এই কসমোভিশন খুব সহজে গ্রহদের উল্টাগতিও (রেট্রোগ্রেড মোশন) ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল, ব্যাখ্যাটা উপরের এনিমেশনে দেখানো হয়েছে। এখানে ভিতরের নীল অর্বিটটা পৃথিবীর, আর বাইরের লালটা মঙ্গল গ্রহের। আর্থ ও মার্স যখন সূর্যের চারদিকে একই দিকে যেতে থাকে তখন আকাশে আমরা মার্সকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যেতে দেখি, এটা স্বাভাবিক প্রোগ্রেড মোশন। কিন্তু পৃথিবীর অর্বিট যেহেতু মার্সের ভিতরে সেহেতু পৃথিবী প্রতি বছর একবার করে মার্সকে ওভারটেক করে। যেভাবে আমার বাস পাশের আরেকটা বাসকে ওভারটেক করার সময় রাস্তার পাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে আমার মনে হবে পাশের বাসটা পিছনের দিকে যাচ্ছে, ঠিক সেভাবেই আমরা যখন মার্সকে ওভারটেক করি তখন আকাশের তারাদের ব্যাকগ্রাউন্ডে মার্সকে উল্টা পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যেতে দেখা যায়। এটাই উল্টাগতির কারণ এবং এটা দিয়ে সব গ্রহের উল্টাগতিই কোপার্নিকাস ব্যাখ্যা করেছিল।

‘রেভলুশনসের’ মাত্র প্রথম ৫% এই কসমোভিশন তুলে ধরে, বাকি ৯৫% জটিল জ্যামিতিক হিসাবে ভরা, যার মাধ্যমে কোপার্নিকাস প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে প্রেডিক্টিভ পাওয়ারের দিক থেকে তার সুন্দর মডেল ‘আলমাজেস্টের’ কিমেরার চেয়ে বেটার না হলেও অন্তত সমান। এবং কোপার্নিকাস এতটুকুই বলতে পেরেছিল, হেলিওসেন্ট্রিক মডেলের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ তার হাতে ছিল না।

5. জিওমেট্রি থেকে ফিজিক্স

নিশ্চিত প্রমাণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আঠার শতক পর্যন্ত। কিন্তু এর মধ্যে নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়াই বেশির ভাগ এস্ট্রোনমার সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, কারণ এই মডেল বেশি সুন্দর। সেই সময়ের সবচেয়ে বড় অব্জার্ভেশনাল এস্ট্রোনমার টাইকো ব্রাহি অবশ্য বিশ্বাস করতে পারেনি। রাজার অনুগ্রহে ব্রাহি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অব্জার্ভেটরি বানিয়েছিল ডেনমার্কের (এখন সুইডেনে) ভেন দ্বীপে, প্রথমে উরানিবর্গ ১৫৭৬ সালে, পরে স্টের্নেবর্গ ১৫৮৪ সালে। বিশাল বিশাল সেক্সটেন্ট ও মুরাল কোয়াড্রেন্ট ব্যবহার করে ব্রাহি সাতশ’র বেশি তারার পজিশন মেপেছিল প্রায় ০.৫ আর্কমিনিট প্রিসিশনে। এতে ‘আলমাজেস্টের’ ডেটা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হয়ে পড়েছিল অকেজো।

bn/un/almagest-revolutions.1740816221.txt.gz · Last modified: 2025/03/01 01:03 by asad

Donate Powered by PHP Valid HTML5 Valid CSS Driven by DokuWiki