বর্বর অবস্থায় বসবাসকারী অসংখ্য গোষ্ঠীর মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ১০০০ সালের মধ্যে চীন, ভারত, মেসোপটেমিয়া, ও মিশরের উর্বর সমতলভূমিতে বড় বড় রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। তারা উচ্চতর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করত, যার লিখিত রেকর্ড পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। আগের স্বাধীন কৃষক সম্প্রদায় ও শহরগুলি তাদের নিজস্ব নেতা ও নাগরিক রাজা, স্থানীয় দেবতা ও পূজার পদ্ধতি নিয়ে আরো বড় পলিটিকেল ইউনিটে যোগ দিচ্ছিল। বন্যাক্রান্ত উর্বর পলি মাটির অস্বাভাবিক উর্বরতা যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ফসল দিত তা হয়ে উঠেছিল একটি আলাদা শাসক ও কর্মচারী শ্রেণীর জীবিকা। এই সংগঠন প্রথমে তৈরি হয়েছিল পানির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন থেকে। এই সব সমভূমিতে সেচ দেয়া বড় নদীগুলি (যেমন, নীল নদ, ইউফ্রেটিস, হুয়াং হো) তাদের বেড পলিতে পূর্ণ করত, কিছু নির্দিষ্ট মাসে আশপাশের খেত প্লাবিত করে তাদের ধ্বংস করত বা উর্বত করত, বা কখনও কখনও সিল্ট দিয়ে নতুন বেড বানাত। পানি সব সময় এক দিকে চালাতে হত, ডাইক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হত, গভীরতা বাড়িয়ে বা খাল খনন করে। এমন নিয়ন্ত্রণ জেলা পর্যায়ে ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল না কারণ এক জেলার স্বার্থ ছিল আরেক জেলার সাথে সাংঘর্ষিক। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন ছিল, কারণ শুধুমাত্র একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষই নিশ্চিত করতে পারে যে স্থানীয় স্বার্থ সাধারণ স্বার্থের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে না। কেবল তখনই উর্বরতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু যখন দেশ ছোট ছোট যুদ্ধবাজ রাজ্যে ভেঙে পড়ে আর বাঁধ ও খালগুলি অবহেলিত হয়, তখন মাটি শুকিয়ে যায় বা প্লাবিত হয়, মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে: তখন জমির উপর আছড়ে পড়ে দেবতাদের ক্রোধ।
একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তি প্রয়োজন ছিল, দ্বিতীয়ত, উর্বর সমভূমিকে পার্শ্ববর্তী পাহাড় বা মরুভূমির যোদ্ধা জাতিদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য। এই যোদ্ধারা তাদের নিজস্ব জমি থেকে ভালো জীবিকা পেত না, তাই লুণ্ঠন ও সমৃদ্ধ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কর আদায়কেই তাদের ব্যবসা করে তুলেছিল। কর্মের একটি বিভাজন প্রয়োজন ছিল; একটা ক্ষত্রিয় বর্ণ গড়ে উঠেছিল যারা তাদের প্রধানকে রাজা বানিয়ে কৃষকদের উদ্বৃত্ত পণ্য নিয়ন্ত্রণকারী শাসক শ্রেণী হয়ে ওঠে। অথবা যাযাবর প্রতিবেশীরা লুণ্ঠনকারী থেকে বিজয়ীতে পরিণত হয়ে কৃষকদের মধ্যেই শাসক অভিজাত হিসেবে স্থায়ীভাবে বসবাস করত, তাদেরকে অন্য হানাদারদের থেকে রক্ষা করত। উভয় ক্ষেত্রে ফলাফল ছিল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র।
বার বার ফিরে ফিরে ঘটা এই গল্পই হলো সংক্ষেপে এই দেশগুলির ইতিহাসের রূপরেখা। বারবার বর্বররা তাদের আক্রমণ করে ও অধিকার করে, কখনও থেকে যায় একটি সংখ্যালঘু উপরিস্তর হিসাবে (যেমন চীনে মাঞ্চু, ভারতে মঙ্গোল, মিশরে হিকসোস), আর কখনও একটি নতুন জাতি আগের অধিবাসীদের সাথে মিশে যায় বা তাদের প্রতিস্থাপন করে, যেমন ভারতে আর্যরা এবং মেসোপটেমিয়ায় সেমাইটরা। বিজয়ের সময় অনেক সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেলেও আক্রমণকারীরা পরবর্তীতে পরাজিতদের উচ্চতর সভ্যতা গ্রহণ এবং আত্মস্থ করে, এবং প্রায়ই তাকে নতুন উদ্দীপনা দেয়। কয়েক প্রজন্ম পরে, তাদের বর্বর শক্তি হারিয়ে যাওয়ার পরে, বিজয়ীরাও নতুন আক্রমণকারীদের আক্রমণের বস্তু হয়ে ওঠে।
এই ধরনের সাম্রাজ্যে রাজাই ছিলেন আইনপ্রণেতা, প্রধান বিচারপতি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রধান যারা বেসামরিক বিভাগের নেতা হিসেবে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি দ্বিতীয় এক শাসক শ্রেণী গঠন করত। সাধারণত এটা পুরোহিতদের নিয়ে গঠিত হতো, যারা প্রথমে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী নেতা হলেও ততদিনে একটা সরকারি হায়ারার্কিতে সংগঠিত হয়েছিল। পুরোহিতদের হাতে ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক ও সাধারণ জ্ঞান তাদের হাতেই ছিল; এটাই ছিল তাদের প্রেস্টিজ ও সামাজিক শক্তির উৎস ছিল। যেখানে কৃষি প্রধান পেশা ছিল সেখানেই ক্যালেন্ডার ও ঋতুর জ্ঞান ছিল তাদের ডোমেইন। রাষ্ট্র ও সমাজের সাথে একীভূত ধর্মও তখন ছিল কেন্দ্রীভূত; প্রধান শহরের স্থানীয় দেবতারা উপরের এক দেবতার অধীনে একটি প্যান্থিয়নে মিলিত হয়েছিল, যেখানে ছোট বা বিজিত স্থানগুলির স্থানীয় দেবতারা হয় নিম্নতর আত্মার পর্যায়ে অবনমিত হয়েছিল নয় অন্য দেবতাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। এভাবেই প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ায় দেবী ইনিনা, নিসাবা ও নানাকে পরবর্তীতে ইশতারের সাথে একীভূত করা হয়। বোর্সিপ্পা বড় হতে হতে খুব দ্রুত যখন ব্যাবিলন শহরের সাবার্ব হয়ে উঠে তখন এর ধর্মতাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তার নগরদেবতা নাবোকে মারদুকের পুত্র ঘোষণা করা হয়। এরিদু, উরুক ও নিপ্পুরের মতো সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলির দেবতারা হিসেবে থেকে গিয়েছিল অতি সম্মানিত এয়া, আনু ও এনলিল (প্রায়ই ‘বেল’ নামে পরিচিত, মানে ‘প্রভু’), কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের পরে ব্যাবিলনের রাজনৈতিক প্রাধান্য বাড়ায় তার স্থানীয় দেবতা মারদুক হয় প্যান্থিয়নের সবচেয়ে সিনিয়র দেবতা। পরবর্তী শতাব্দীতে যখন আসিরিয়া মেসোপটেমিয়ান বিশ্বের প্রভুত্ব অর্জন করে তখন আশুর এই স্থান দখল করে। এরকম হায়ারার্কিতে সজ্জিত হলে দেবতারা তাদের কিছু স্থানীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং প্রাকৃতিক শক্তির ব্যক্তিরূপ হিসাবে তাদের চরিত্র বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। পরের দিকে উরের দেবতা সিন এবং সিপ্পারার দেবতা শামাশ সব সময় চাঁদ ও সূর্যের দেবতা হিসেবে শ্রদ্ধা পেত।
যখন শাসক শ্রেণী হিসাবে এমন এক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে যাকে আর কঠোর পরিশ্রম করে জীবন সুরক্ষিত করতে হয়নি তখন অস্তিত্বের এক নতুন অবস্থা তৈরি হয়। সামাজিক কাঠামো আরও জটিল হয়ে ওঠে, আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের জন্য আরো বেশি যোগ্যতা লাগে এবং সেই নেতৃত্ব আরো বড় দাবি প্রতিষ্ঠা করে। বাণিজ্য ও ব্যবসা নতুন বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা সৃষ্টি করেছিল, এবং রাজা ও প্রভুদের সম্পদ ও বিলাসিতার সাথে শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। অতএব, পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো নতুন সামাজিক কাঠামোর সাথে সাথে উচ্চতর সংস্কৃতির রূপগুলি তৈরি হয়েছিল, যা প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতার সবচেয়ে বিকশিত অর্জনও ছাড়িয়ে যায়। শুরু হয়েছিল সভ্যতার যুগ।
এর সাথে এস্ট্রোনমিতেও আসে নতুন উন্নয়ন। এর সরাসরি কারণ ছিল সময় মাপার চাহিদা, এবং বিশেষ করে চাঁদের ক্যালেন্ডারকে সৌর বছরের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা।
চাঁদের একটি পিরিয়ড গড়ে ২৯.৫৩০৫৯ দিন; একটি সৌর বছর ৩৬৫.২৪২২০ দিন, অর্থাৎ ১২টি চন্দ্রমাসের চেয়ে ১১ দিন বেশি; বারো চন্দ্রমাসে ৩৫৪.৩৬৭১ দিন হয়। তিন বছর পরে চাঁদের ক্যালেন্ডার সূর্যের প্রগতির তুলনায় ৩৩ দিন পিছিয়ে যাবে। সূর্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য প্রতি তৃতীয় বছরে, কখনও কখনও আরও তাড়াতাড়ি, একটি অতিরিক্ত মাস যোগ করতে হতো, এবং সে বছর ১২ মাসের পরিবর্তে মাস হতো ১৩টা। ক্যালেন্ডার সমস্যার মূলে আছে এমন একটা বড় পিরিয়ড খুঁজে পাওয়া যা মাস ও বছরের সাধারণ গুণিতক (কমন মাল্টিপল); সেক্ষেত্রে এই পিরিয়ডের পরে সূর্য ও চাঁদ একই পারস্পরিক অবস্থানে ফিরে আসবে। অবশ্যই একদম একজাক্ট কোনো সাধারণ গুণিতক নেই, তবে কমবেশি সন্তোষজনক এপ্রক্সিমেশন পাওয়া যেতে পারে। সূর্য ও চাঁদের পিরিয়ড নিয়ে আমাদের আধুনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা তাত্ত্বিকভাবে এই জাতীয় পিরিয়ড সহজেই বের করতে পারি। এজন্য প্রথমে তাদের অনুপাতকে একটি অবিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশে রূপান্তরিত করতে হয় এবং তারপর একের পর এক তার এপ্রক্সিমেশন লিখতে হয়। আভেবাই আমরা ৮/৯৯ এবং ১৯/২৩৫ খুঁজে পাই, প্রথমটার অর্থ হলো ৮ সৌর বছর প্রায় ৯৯ চন্দ্রমাসের সমান (যথাক্রমে ২৯২১.৯৪ ও ২৯২৩.৫৩ দিন), তাই এই ৮ বছরের মধ্যে ৩টিতে অবশ্যই ১৩তম মাস আছে এবং ৫টিতে মাস ১২টি করে। তবু এই অনুমান খুব একটা ভালো নয়; মাত্র ২৪ বছর পরেই চন্দ্রতারিখ সৌর ঋতুর তুলনায় ৫ দিন পিছিয়ে যায়। এর চেয়ে অনেক ভালো পিরিয়ড ১৯ বছরেরটা যার মধ্যে ২৩৫ চন্দ্রমাস আছে (যথাক্রমে ৬৯৩৯.৬০ ও ৬৯৩৯.৬৯ দিন); এখানে ১৩তম মাস ঢুকাতে হয় উনিশ বছরে মোট সাত বার। অবশ্যই আদিম যুগে মানুষের পিরিয়ড সম্পর্কে এই একজাক্ট জ্ঞান ছিল না; তাদের জন্য একটি ভালো ক্যালেন্ডার পিরিয়ড বের করা ছিল খুব কঠিন ব্যবহারিক সমস্যা, সৌর ও চান্দ্র হিসাব অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে যথাসাধ্য কাছাকাছি আনাই ছিল তাদের কাছে একমাত্র সমাধান। সুতরাং এই সমস্যা মহাকাশের বিভিন্ন ঘটনা অনেক মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণের পিছনে চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এই ধরনের নির্ভুলতা প্রয়োজন ছিল, যেহেতু কৃষির জন্য এত নিখুঁত কখনোই হতে হয় না, কারণ আবহাওয়ার ওঠানামার কারণে কৃষিকাজ ভালোই অনিয়মিত। আমাদের মনে রাখা উচিত যে সেই সময়ে কৃষিকাজের সাথেই হতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব। সব মহান ও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ঘটনার মতোই কৃষি উৎসব ছিল একইসাথে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দেবতারা প্রভাবশালী প্রাকৃতিক ও সামাজিক শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের জীবনে তাদের ভাগ বসিয়েছিল; সামাজিকভাবে যা প্রয়োজনীয় বা পর্যাপ্ত ছিল তা দেবতাদের আদেশে পরিণত হয়েছিল, আচার-অনুষ্ঠানে কঠিনভাবে গেঁথে গিয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে প্রাকৃতিকভাবে যা ঘটে, যেমন, ফসল তোলা বা নবান্ন, তা ধর্মীয় উদযাপন হিসাবে একটি নির্দিষ্ট তারিখে স্থির করা হয়েছিল, যেমন, চাঁদের কোনো নির্দিষ্ট দশায়। দেবতাদের সেবায় কোনো ধরনের হেলাফেলা গ্রাহ্য করা হতো না; প্রত্যেক আচার পালন করতে হতো একদম নিয়ম মতো। ক্যালেন্ডার ছিল আসলে রিচুয়াল বা আচারানুষ্ঠানের কালানুক্রমিক অর্ডার। এর ফলে ক্যালেন্ডার হয়ে গিয়েছিল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে পুরোহিতদের নিয়মিত যত্নের বিষয়, কিন্তু একইসাথে শুভ সময়ের জ্ঞানে একচেটিয়া অধিকারের কারণে এটা ছিল তাদের সামাজিক শক্তিরও উৎস।
কীভাবে এই ধরনের কৃষি-ধার্মিক প্র্যাক্টিস থেকে লুনিসোলার ক্যালেন্ডার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে কিছু আকর্ষণীয় উদাহরণ আমাদের কাছে এসেছে। ইহুদি ক্যালেন্ডার চাঁদের উপর ভিত্তি করে বানানো কারণ তা মরুভূমিতে তৈরি হয়েছিল; কিন্তু ইহুদিরা কেনান দেশে এসে কৃষিজীবী হয়ে ওঠায় ক্যালেন্ডারকে সূর্যের সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। বসন্তে ‘মাসোথ’ ছিল ফসল কাটার উৎসব; বার্লির প্রথম ছড়া দেবতাদের নিবেদন করা হতো এবং প্রথম শস্য থেকে খামিরবিহীন রুটি বানানো হতো। এই উদযাপন মিলে গিয়েছিল নমাডিক ‘পাসাহ’ উৎসবের সাথে, যেখানে বসন্তের পূর্ণিমা রাতে জেহোভার কাছে নবজাতক মেষশাবক উৎসর্গ করা হয়। তাই এর ক্ষণ ছিল প্রথম মাস অর্থাৎ নিসানের পূর্ণিমা। এই মিল কিভাবে হয়েছিল তা আমরা গিঞ্জেলের ক্রোনলজি বিষয়ক দুর্দান্ত টেক্সটবুকে পড়েছি: “শেষ মাসের শেষের দিকে পুরোহিতরা ক্ষেতের ফসলের অবস্থা পরিদর্শন করে দেখতেন যে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বার্লি পাকতে পারে কিনা। যদি তারা দেখতেন যে পাকবে, তাহলে মাসোথ-পাসাহ পরবর্তী অমাবস্যার সাথে শুরু হওয়া মাসে নির্ধারণ করা হতো; কিন্তু পাকার আশা না দেখলে উৎসবের মাসটি চাঁদের এক পিরিয়ডের সমান পিছিয়ে দেওয়া হতো। এর ফলে অন্যান্য উৎসবের দিনগুলিও নির্ধারিত হয়ে যেত।”
এই এম্পিরিকেল পদ্ধতি ইস্রায়েলিদের ততদিনই কাজে লেগেছিল যতদিন তারা ফিলিস্তিনে একসঙ্গে বসবাস করত। পরে যখন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, এটা আর ব্যবহার করা যেত না; কিন্তু ততদিনে জ্যোতির্বিদ্যা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে তারা তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ক্যালেন্ডার পিরিয়ডের জ্ঞান গ্রহণ করতে পেরেছিল। পরবর্তীতে ১২ মাসের ১২ বছর আর ১৩ মাসের ৭ বছর দিয়ে বানানো ১৯ বছরের পিরিয়ডই ইহুদি ক্যালেন্ডারের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
মুহাম্মাদের আগে আরবের একটি উন্নয়ন আরেকটি উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়। পবিত্র মাসগুলিতে রক্তের প্রতিশোধ স্থগিত করা হয়েছিল যখন কাফেলা বিপদ ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারত, কারণ এটা অর্থনৈতিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে অন্তহীন বিবাদ ছিল খুব স্বাভাবিক, এবং রক্তের প্রতিশোধ এক গোত্রের সব সদস্যের মধ্যে সংহতির আদিম আইনি রূপ হিসেবে অপরিহার্য ছিল, কিন্তু এর সীমাহীন আধিপত্য বাজার ও খাদ্যের বণ্টন অসম্ভব করে তুলতে পারে। মাসুদি বলেছেন: ‘সফর মাসটির নাম ইয়েমেনের বাজার থেকে নেওয়া হয়েছে। … এখানে আরবরা তাদের শস্য কিনত, এবং যে কিনত না সে ক্ষুধায় মারা যেত।’ পবিত্র মাসটি ছিল বাজারের মাস; চারদিক থেকে কাফেলাগুলো বড় বড় বাজারের শহরে বিশেষ করে মক্কায় যেত, যা তার জমজম নামের অতুলনীয় শীতল কুয়ার জন্য বিখ্যাত, আরবে তীর্থস্থান হিসেবে তার গুরুত্ব এই কুয়ার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে বিভিন্ন গোত্র মিলিত হতো, কথা বলত, সমাবেশের স্থানটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র এবং রাজধানী হয়ে ওঠেছিল। সুতরাং এটা আবশ্যক ছিল যে পবিত্র মাসটি প্রত্যেক বছরের একই সময়ে পড়া উচিত, যখন ফসল তোলা হয়, শস্য পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের একজন মুসলিম পণ্ডিত আলবিরুনি লিখেছেন: “পৌত্তলিক যুগে আরবরা তাদের মাসগুলিকে এখনকার মুসলমানদের মতোই ব্যবহার করত এবং তাদের তীর্থযাত্রা বছরের চারটি ঋতুর মধ্য দিয়েই চলত। কিন্তু পরে তারা তাদের তীর্থযাত্রা এমন এক সময়ে ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেয় যখন তাদের জিনিসপত্র, চামড়া ও ফল বাজারে তোলার জন্য প্রস্তুত থাকত; তাই তারা এটিকে স্থির করার চেষ্টা করেছিল, যাতে এটি সব সময় সবচেয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ ঋতুতে থাকে। এজন্যই তারা হিজরতের ২০০ বছর আগে ইহুদিদের কাছ থেকে ইন্টারকেলেশন পদ্ধতি শিখেছিল। এবং তারা তা ইহুদিদের মতোই প্রয়োগ করেছিল, তাদের বছর ও সৌর বছরের মধ্যে পার্থক্যটা বছরের মাসের সাথে তখন যোগ করে যখন পার্থক্য এক মাস হয়ে যায়। তারপর তীর্থযাত্রার অনুষ্ঠান শেষে কালাম্মা-রা (একটি নির্দিষ্ট গোত্রের শেখরা, এই কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত) এগিয়ে আসেন, সবার সাথে কথা বলেন এবং নতুন একটা মাস যোগ করেন পরের মাসের নাম বর্তমান মাসের নামে রাখার মাধ্যমে। উপস্থির সবাই করতালির মাধ্যমে কালাম্মাদের সিদ্ধান্তের অনুমোদন দেয়। এই পদ্ধতিকে তারা বলে ‘নাসি’ অর্থাৎ স্থানান্তর, কারণ প্রতি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে বছরের সূচনা স্থানান্তরিত হত। … তারা মঞ্জিলের উদয় ও অস্তের পরে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারত। এই প্রথাই চলছিল মক্কা থেকে মদিনায় নবীর হিজরতের আগ পর্যন্ত।”
হিজরতের নয় বছর পর মুহাম্মাদ এই স্থানান্তর নিষিদ্ধ করেছিলেন, সম্ভবত কালাম্মাদের কাজ কেড়ে নিয়ে তাদের আধ্যাত্মিক শক্তি ভেঙে ফেলার জন্য এবং ইহুদিদের থেকে নিজেকে আরও তীব্রভাবে আলাদা করার জন্য। তাই এখন ইসলামি ক্যালেন্ডার ৩৫৪ দিনের চান্দ্র বছরের উপর ভিত্তি করে চলে, প্রতি বছর ১২টা চন্দ্রমাস, যারা ৩৩ বছরে সব ঋতু একবার অতিক্রম করে। এখানে আমরা এমন এক ক্যালেন্ডার পাই যা সাংবিধানিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সামাজিক প্র্যাক্টিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রাচীন বেদুইন জীবনধারার এক ধর্মীয় মমি হিসেবে টিকে আছে।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক শর্ত ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ফলাফল হিসেবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে কীভাবে ক্যালেন্ডার ও এস্ট্রোনমির যৌথ বিকাশ ঘটেছে তার ভালো উদাহরণ এখানে পাওয়া যায়।