সক্রেটিস: গতকাল রবি আমাদেরকে পার্টিকেল যুগ সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছে, এবং সাথে এটাও বলেছে যে তার দেয়া ধারণাটা এই যুগ আসলেই ‘বুঝার’ জন্য একদমই যথেষ্ট না। সত্যিকার অর্থে বুঝতে হলে গণিত ছাড়া গতি নাই। শশীর আজকে গ্যালাক্টিক যুগ নিয়ে আলোচনা শুরু করার কথা, যা চলতে থাকবে যতদিন আমরা সাংপো নদীতে আছি। কিভাবে শুরু করতে চাও?
শশী: এখন যেহেতু রাত বেশ গভীর, আমরা সাংপোর তীরে, আর আকাশেও মেঘ নেই, সেহেতু টেলিস্কোপ দিয়ে একটা গ্যালাক্সির ছবি তুলেই শুরু করা যায়।
রবি: ভালো আইডিয়া। শশী, তাহলে অশ্বিন-১ তুমিই চালাও।
সক্রেটিস: অশ্বিন-১ মানে?
রবি: আমাদের দুইটা টেলিস্কোপ আছে, দুই জনের নাম জেমিনাই কনস্টেলেশনে যমজ ভাই হিসেবে পরিচিত দুই তারা অশ্বিন ১ ও ২ এর নামে।
শশী: এই টেলিস্কোপ মাউন্টে বসানোর পর ফোন থেকে ইউনিস্টেলার অ্যাপ দিয়ে কানেক্ট করলাম, দেখো। এখন অ্যাপের ক্যাটালগে গিয়ে একটা গ্যালাক্সি সিলেক্ট করে ‘গোটু’ অপশনে ট্যাপ করলেই অশ্বিন চলা শুরু করবে। আমি ফোন দিয়ে অপারেটর হিসেবে জয়েন করেছি, তোমরা সবাই একই অ্যাপে গিয়ে অশ্বিনে অব্জার্ভার হিসেবে যুক্ত হলে টেলিস্কোপ যা দেখছে তাই ফোনে দেখতে পারবে।
জুনো: হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয় হোয়ার্লপুল গ্যালাক্সিটা টার্গেট করা উচিত।
শশী: আচ্ছা এই ট্যাপ করলাম। এখন সবাই দেখতে পাচ্ছ অশ্বিন-১ হোয়ার্লপুলের দিকে যাচ্ছে। পৌঁছে গেছে। এখনো গ্যালাক্সিটা দেখা যাবে না, কারণ আমরা লাইভ মোডে দেখছি, ফোটন জমা করছি না। এই ‘এনহান্সড ভিশনে’ ট্যাপ করলে অশ্বিন লাইট জমানো শুরু করবে। এই শুরু হলো। দেখতে পাচ্ছ নিচে এক্সপোজার টাইম, ৭ সেকেন্ড হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। হোয়ার্লপুল ইতিমধ্যেই হালকা দেখা যাচ্ছে। লাইট যত জমা হবে গ্যালাক্সি তত স্পষ্ট হবে।
সক্রেটিস: এ তো দেখি দুই গ্যালাক্সির মার্জার।
শশী: সামনে মেসিয়ে ৫১ নামে পরিচিত হোয়ার্লপুল, সাইজ প্রায় ৭৫ হাজার লাইট ইয়ার, আর তার একটু পিছনে মাত্র ১৫ হাজার লাইট ইয়ার সাইজের ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি এনজিসি ৫১৯৫ যার আরেক নাম এম ৫১এ। দুজনেই প্রায় তিন কোটি লাইট ইয়ার দূরে। নীলচে আলো আসছে নবীন তারা থেকে, আর লালচে আলো প্রবীণ তারা থেকে। আমাদের ইউনিভার্সে বর্তমানে প্রায় এক ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে যাদের সবাই তৈরি হয়েছিল ইউনিভার্সের চৌদ্দ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে প্রথম চার বিলিয়ন বছরের মধ্যে।
সক্রেটিস: তার মানে মহাবিশ্বের প্রথম তিন লাখ বছর যদি হয় পার্টিকেল যুগ বা কণা যুগ, তাহলে তার পর থেকে প্রায় চার বিলিয়ন বছর বয়স পর্যন্ত হলো গ্যালাক্টিক যুগ। কিন্তু তুমি গ্যাস-তারা-ধুলার যে বিশাল কাঠামো দেখাচ্ছ তার সাথে তিন লাখ বছর বয়সি ইউনিভার্সের কোনো মিল পাচ্ছি না। আরেকটু পরিষ্কার করি। গতকাল রবি আমাদেরকে মহাবিশ্বের তিন লাখ বছর বয়সের একটা ছবি দেখিয়েছে। ছবিটা দেখিয়ে রবি প্রমাণ করেছে যে ইউনিভার্স তখন একটা সিঙ্গেল বোরিং গ্যাস ছিল যার সবখানে তাপমাত্রা প্রায় সমান। তাপমাত্রার পার্থক্য যে ছিল না তা না, তবে খুব কম, গড়ে মাত্র ৩০০ মাইক্রোকেলভিন। এত বোরিং একটা গ্যাস থেকে চার বিলিয়ন বছরে এত বিশাল সব গ্যালাক্সি কিভাবে তৈরি হলো? একটা দুইটাও তো না, এক ট্রিলিয়ন, বা হয়ত আরো বেশি।
শশী: সেটা বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক দিকে অব্জার্ভেশনাল এস্ট্রোনমাররা পর্যবেক্ষণ করছে, আরেক দিকে থিওরেটিকেল এস্ট্রোফিজিসিস্টরা অংক করছে। অংকের সাথে অব্জার্ভেশন খুব বেশি এখনো মিলানো যায়নি, কারণ মহাবিশ্বের তিন লাখ বছর বয়সের পর থেকে শুরু করে প্রায় একশ কোটি বছর বয়স পর্যন্ত যে বিশাল জন্মযজ্ঞ চলেছে তা টেলিস্কোপ দিয়ে এখনো সরাসরি দেখা যায়নি। প্রথম বিশ কোটি বছর ছিল ডার্ক এইজ, তার পর আরো বিশ কোটি বছর ধরে চলে কসমিক ডন, মানে প্রথম তারা ও গ্যালাক্সিদের জন্মের যুগ। আর তার পরের ষাট কোটি বছরের নাম দেয়া হয়েছে রিআয়োনাইজেশন ইপক, কারণ তখন প্রথম তারাদের অতিবেগুনি আলোর আঘাতে ইন্টারগ্যালাক্টিক মিডিয়ামে থাকা সব আদিম নিউট্রাল হাইড্রোজেন আবার আয়নিত হয়ে গিয়েছিল, মানে তাদের এটম থেকে ইলেক্ট্রন খসে পড়েছিল।
সক্রেটিস: প্রথমে বললে বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝার ‘চেষ্টা’ করছে, কিন্তু তারপর যে বিশাল কাহিনি শোনালে তাতে মনে হচ্ছে অনেকটাই বুঝে গেছে। কোনটা ঠিক?
শশী: এই ভিডিওটা দেখে তুমি নিজেই সিদ্ধান্ত নাও। একুশ শতকের শুরুতে ‘মিলেনিয়াম রান’ নামে একটা বিরাট কম্পিউটার সিমুলেশন করেছেন তাত্ত্বিক এস্ট্রোফিজিসিস্টরা। তারা একটা সুপারকম্পিউটারকে বলেছেন কসমোলজি ও ফিজিক্সের মৌলিক সব গাণিতিক তত্ত্ব ইউজ করে এমন একটা সিমুলেশন বানাতে যেখানে চার লাখ বছর বয়সের পর থেকে ইউনিভার্সের একটা ছোট অংশের পুরো ইতিহাস দেখা যাবে। মানে তারা ইউনিভার্সের একটা টাইমল্যাপ্স মুভি বানিয়েছেন, রিয়েল মুভি না, সিমুলেটেড মুভি।
সক্রেটিস: গুগল আর্থে হিস্টরিকেল ইমেজারিতে গেলে যে-টাইমল্যাপ্স দেখা যায় তার মতো কিছু বুঝাচ্ছ।
শশী: ভালো কথা মনে করেছ। চলো গুগল আর্থ দিয়েই বুঝার চেষ্টা করি। এই ম্যাপে ঢাকার ‘মুখ’ দেখতে পাবে ২০২২ সালের ছবিতে, কারণ বুড়িগঙ্গা নদী ঢাকার পশ্চিম সীমান্তে এমন একটা শেইপ বানিয়েছে যা মানুষের মস্তিষ্ক মানুষের মুখ ভাবতেই ভালোবাসে। কিন্তু ১৯৮৪ সালে এই মুখ ছিল না, কারণ তখন নদীর দুই পাশে ধূসর দালান না থাকায় নদীর রেখা স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে বুঝা যেত না। আমরা যত ২০২২ সালের দিকে যাই দালান তত বাড়তে থাকে, সবুজ ধ্বংস করে উটের গ্রীবার মতো তত এগিয়ে আসে ধূসর। হয়ত বলা যায়, ১৯৮৪ থেকে ২০২২ সালের দিকে আসার পথে ঢাকা যত ‘মানুষ’ হয় তার সবুজ তত ধ্বংস হতে থাকে।
সক্রেটিস: এর সাথে এখন পুরো মহাবিশ্বের তুলনা করে বসবে না কি?
শশী: কেন নয়? ঢাকার টাইমল্যাপ্স ছবিতে যেমন দেখছ বিল্ডিঙের স্ট্রাকচার আস্তে আস্তে সবুজ ধ্বংস করে দিচ্ছে তেমনি ইউনিভার্সের টাইমল্যাপ্স মুভি বানাতে পারলে আমরা দেখতাম কিভাবে গ্যালাক্সির স্ট্রাকচার থেকে আল্ট্রাভায়োলেট আলো বের হয়ে ইন্টারগ্যালাক্টিক মিডিয়ামের নিরীহ নিউট্রাল সব হাইড্রোজেন গ্যাস ধ্বংস করে দিচ্ছে, মানে আয়নিত করছে, তাদের এটম থেকে ইলেক্ট্রন কেড়ে নিচ্ছে। বিল্ডিং যদি হয় গ্যালাক্সির উপমা, তবে গ্যালাক্সির বাইরে থাকা সব হাইড্রোজেন গ্যাস হল সবুজের উপমা।
সক্রেটিস: কিন্তু মিলেনিয়াম সিমুলেশন তো সেটা দেখাচ্ছে না।
শশী: ঠিক ধরেছ। ইউনিভার্সের তেমন টাইমল্যাপ্স মুভি আমরা এখনো বানাতে পারিনি, আগামী কয়েক দশকে আরো উন্নত টেলিস্কোপ দিয়ে বানানো সম্ভব হতে পারে। এখন এই সিমুলেশনই ভরসা। মুভিটাতে দেখবে গত ১৩.৫ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস, পুরো ইউনিভার্সের না, মুভিতে যে অংশটা দেখা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্য হরিজন্টাল দিকে ৬০০ মিলিয়ন লাইট ইয়ার, ভার্টিকেল দিকেও ৬০০ মিলিয়ন লাইট ইয়ার। মহাবিশ্বে একটা গ্যালাক্সি থেকে আরেকটা গ্যালাক্সির দূরত্ব যদি গড়ে ১ মিলিয়ন লাইট ইয়ার ধরি, তাহলে ছবির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পাশাপাশি ৬০০টা গ্যালাক্সি কল্পনা করা যায়, যা দূরত্বের স্কেলটা বুঝার ভালো উপায়।
সক্রেটিস: আর উপরে যে $z$ দেখা যাচ্ছে সেটা কি, এর মান দেখি মুভি চলার সময় ২০ থেকে ০ পর্যন্ত আসছে, গুগল আর্থে যেমন ১৯৮৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আসছিল।
শশী: এর নাম রেডশিফট, কিন্তু এটা ব্যাখ্যা করতে গেলে এখন আমরা আমাদের শিক্ষার আসল রাস্তা থেকে সরে যাব। আপাতত এটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে রেডশিফট এখানে সময়ের প্রক্সি, রেডশিফট $z=20$ মানে মহাবিশ্বের বয়স ৪০ কোটি বছর, আর $z=0$ মানে বর্তমান। মহাবিশ্বের বয়স এখন যদি ১৩৯০ কোটি বছর হয়, তাহলে এই টাইমল্যাপ্স মুভি আসলেই আমাদেরকে গত ১৩৫০ কোটি বছরের পুরো ইতিহাস দেখিয়ে দিচ্ছে।
সক্রেটিস: কিন্তু কি দেখাচ্ছে? মুভির প্রথম ফ্রেম পরিচিতই লাগছে, দেখে মনে হচ্ছে আমাদের সেই তিন লাখ বছর বয়সি গ্যাস যেখান থেকে সিএমবি এসেছিল। কিন্তু তার পর এই গ্যাস থেকে মানুষের মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্কের মতো যে বিশাল জালের জন্ম হচ্ছে তা আসলে কি?
শশী: সক্রেটিস, তোমার চেয়ে ভালো রূপক কেউ বের করতে পারে না। ব্রেইনের সাথে তুলনা খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে তার আগে গ্যালাক্সিদের জন্মের সাধারণ প্রসেসটা বলে নেই। পার্টিকেল যুগের শেষে তিন লাখ বছর বয়সি যে-গ্যাস দেখেছিল সেখানে কোথাও কোথাও তাপমাত্রা গড়ের চেয়ে একটু কম ছিল, এবং এই কারণে এসব জায়গায় গ্যাসের ঘনত্বও বেশি ছিল। সময়ের সাথে ইউনিভার্স প্রসারিত হলেও এই সব ঘন জায়গার গ্যাস সেই প্রসারণ মানেনি, তারা উল্টা গ্র্যাভিটির কারণে দিন দিন আরো ঘন হয়েছে। ঘন হতে হতে যখন তাদের মধ্যে খণ্ড খণ্ড গ্যাস থেকে অনেক তারা তৈরি হতে থাকে, তখনই শুরু হয় গ্যালাক্সির জন্ম। প্রথম দিকে গ্যালাক্সিগুলো বেশ অগঠিত অনিয়মিত বা ইরেগুলার ছিল। আস্তে আস্তে তাদের কাঠামো সংহত হয়েছে। মিলেনিয়াম সিমুলেশন আমাদেরকে এই প্রক্রিয়াটাই দেখাচ্ছে। এই মুভিতে প্রতিটা উজ্জ্বল বিন্দু একেকটা গ্যালাক্সির পজিশন বুঝাচ্ছে। নিউরন যেমন মানুষের মস্তিষ্কের গাঠনিক ইউনিট, গ্যালাক্সি তেমনি মহাবিশ্বের গাঠনিক ইউনিট। প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন দিয়ে হয় ব্রেইনের নেটওয়ার্ক, আর প্রায় এক ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি দিয়ে গঠিত হয়েছে কসমিক ওয়েব, কারণ তা দেখতে জালের মতো। মুভিতে কসমিক ওয়েবের যে-অংশটা দেখছ তা দিয়েই পুরোটা আন্দাজ করা যায়। যেখানে গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সংখ্যা অনেক বেশি তার নাম নোড, আর বিভিন্ন নোড যুক্ত হচ্ছে ফিলামেন্ট দিয়ে, যেখানে গ্যালাক্সির সংখ্যা কম।
সক্রেটিস: তুমি বললে এখানে প্রতিটা উজ্জ্বল বিন্দু একেকটা গ্যালাক্সির পজিশন, পজিশন কেন, এগুলো কি আসলেই গ্যালাক্সি হওয়া উচিত না?
শশী: এই বিন্দুগুলোকে ঠিক গ্যালাক্সি বলা যাবে না, কারণ মিলেনিয়াম রান বানানো হয়েছে ডার্ক ম্যাটার দিয়ে।
সক্রেটিস: সেটা আবার কি জিনিস?
শশী: বিজ্ঞানীরা মনে করছেন আমাদের মহাবিশ্বে মোট যে-পরিমাণ এনার্জি-ম্যাটার আছে তার মাত্র ৫% আমাদের পরিচিত সাধারণ এনার্জি-ম্যাটার (পার্টিকেল যুগে আলোচিত সবকিছু), ২৫% ডার্ক ম্যাটার, আর বাকি ৭০% ডার্ক এনার্জি। যে ম্যাটার ও এনার্জি মহাবিশ্বে থাকার কথা কিন্তু আমরা সরাসরি ডিটেক্ট করতে পারছি না তাদের নামের আগেই ‘ডার্ক’ বসানো হয়েছে। তার মানে সাধারণ ভিজিবল ম্যাটারের চেয়ে ডার্ক ম্যাটার প্রায় ৫ গুণ বেশি। গ্র্যাভিটি যেহেতু ভরের সমানুপাতিক, আর ডার্ক ম্যাটার যেহেতু বেশি ভারী, সেহেতু ডার্ক ম্যাটার দিয়েই গ্যালাক্সির কাঠামো গঠিত হওয়ার কথা। ডার্ক ম্যাটার সিমুলেট করতে পারলেই ভিজিবল ম্যাটারের বিন্যাস দেখা হয়ে যাবে। তাই মিলেনিয়াম সিমুলেশনে ১০ বিলিয়ন ডার্ক ম্যাটার ‘কণা’ সিমুলেট করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটা কণার ভর সূর্যের ১ বিলিয়ন গুণ। মানে আমাদের টাইমল্যাপ্স মুভির কয়েকশ বিন্দু একসাথে একটা গ্যালাক্সির স্ক্যাফোল্ডিং বানাচ্ছে, যার মধ্যে ভিজিবল ম্যাটার বানাতে পারে কয়েকশ বিলিয়ন তারা।
সক্রেটিস: এস্ট্রোনমাররা ডার্কে কাজ করতে করতে ডার্কের প্রেমে পড়ে গেছে মনে হয়। তাত্ত্বিকদের সব থিওরিও ডার্ক সাইডে চলে যায় কি না তাই ভবিষ্যতে দেখার বিষয়। মানুষ যতটা জানে তার চেয়ে অনেক বেশি জানে না এবং তার চেয়েও অনেক বেশি জানার দাবি করে।
মার্স: আগামী বিশ বছরের মধ্যেই আমরা হয়ত মিলেনিয়াম রানের বাস্তব প্রমাণ পেতে শুরু করব।
সক্রেটিস: ভালো। আমার আরেকটা প্রশ্ন। তুমি বললে সব গ্যালাক্সি প্রথম চার বিলিয়ন বছরের মধ্যে জন্মেছে। তার পরে বা এখন বা ভবিষ্যতে আর গ্যালাক্সির জন্ম সম্ভব না কেন?
শশী: কারণ, সক্রেটিস, ঘন গ্যাস গ্র্যাভিটির কারণে সংকুচিত হতে হতে আরো ঘন হয়ে এক সময় গ্যালাক্সিতে পরিণত হয়। এখন ঘন গ্যাসই যদি না থাকে তাহলে গ্যালাক্সি বানানো শুরু করাই সম্ভব না। বিগব্যাঙের কারণে ইউনিভার্স প্রসারিত হতে হতে চার বিলিয়ন বছরের মধ্যেই এত বড় হয়ে গিয়েছিল যে গ্যালাক্সি বানানোর জন্য পর্যাপ্ত ঘন গ্যাস আর অবশিষ্ট ছিল না। বেশির ভাগ গ্যাসই আসলে গ্যালাক্সি হতে পারেনি, এদের মাধ্যমেই গঠিত হয়েছে ইন্টারগ্যালাক্টিক মিডিয়াম, মানে এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সির মাঝখানের ফাঁকা জায়গা যেখানে গ্যাসের ঘনত্ব অনেক কম। কসমিক ওয়েবে অবশ্য ইন্টারগ্যালাক্টিক মিডিয়ামের চেয়েও ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়, যেখানে গ্যাসের ঘনত্ব আরো কম, এদের নাম কসমিক ভয়েড। কসমিক ওয়েবে এই সব ভয়েডের বিপরীতে পাওয়া যায় গ্যালাক্সিদের ক্লাস্টার ও সুপারক্লাস্টার, সবচেয়ে ঘন ঘন জায়গায়, নোডের মধ্যে।
হার্মিস: তোমাদের মিলেনিয়াম রান দেখে আমার দৌঁড়াতে ইচ্ছা করছে। পৃথিবীর গ্র্যাভিটির মধ্যে আর কত? আমরা এমনিতেও আকাশের মানুষ। হোয়ার্লপুলের ছবি টেলিস্কোপে দেখে আমার ভালো লাগছে না। চলো সরাসরি হোয়ার্লপুল গ্যালাক্সিতে চলে যাই, সবাই।
[মিলেনিয়াম সিমুলেশনের স্টিমুলেশনে সবাই উড়াল দেয় শূন্যে। মিল্কিওয়ে পার হওয়ার পর শশী সবাইকে থামায়।।]
শশী: দাঁড়াও, দাঁড়াও। এন্ড্রমিডা গ্যালাক্সি অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু হোয়ার্লপুল আরো তিন কোটি লাইট ইয়ার দূর। ভয়েজার-১ যেমন সৌরজগৎ হেকে বের হওয়ার পথে একবার উল্টা ঘুরে পৃথিবীর দিকে ফিরে তুলেছিল ‘পেইল ব্লু ডট’ নামের বিখ্যাত ছবি, তেমন চলো আমরাও একবার মিল্কিওয়ের দিকে ফিরে তাকাই।
[সবাই মিল্কিওয়ের দিকে তাকিয়ে ধ্যানে বসে।]
সক্রেটিস: মিল্কিওয়ের মুখ এই ফেস-অন ভিউয়ে দেখতে আসলেই অসাধারণ। নাসা আইসের এনিমেশনে যেমন দেখা যেত তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। ব্যাখ্যা করো, শশী।
শশী: আমাদের স্পাইরাল গ্যালাক্সিকে ভারতীয়রা আদর করে ডাকে আকাশগঙ্গা, যেন পৃথিবীর গঙ্গা নেমেছে আকাশ থেকেই। এই রূপে অবশ্যই কোনো মানুষের পক্ষে মিল্কিওয়ে দেখা সম্ভব হবে না। এই গ্যালাক্সির ব্যাস ১ লাখ লাইট ইয়ার, যা আলোর বেগে অতিক্রম করতেই লাগবে ১ লাখ বছর। আর যদি ভয়েজারের মতো একটা স্পেসক্রাফটের গড় বেগে যাই (১৭ কিমি/সেকেন্ড) তাহলে লাগবে ২ বিলিয়ন বছর। ভাগ্য ভালো আমরা মারা গেছি, বেঁচে থাকলে এই সৌভাগ্য হতো না।
সক্রেটিস: গ্যালাক্সির মাঝখানটা এত উজ্জ্বল কেন?
শশী: একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি যদি একটা দেশ হয় তাহলে কেন্দ্রটা হলো রাজধানী, সেখানে তারার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। স্টার বেশি কারণ একদম কেন্দ্রে আছে একটা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল, যা আমাদেরকে আবারো মনে করিয়ে দিতে পারে মৃত্যুর কথা: আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই আছে এক বিশাল গণকবর।
সক্রেটিস: সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল মানে গণকবর?
শশী: ব্ল্যাকহোল হচ্ছে বড় তারার লাশ, সূর্যের চেয়ে কয়েক গুণ বড় তারার। এসব তারা মরার পরে অনেক ঘন হয়ে যাওয়ায় সেখানে গ্র্যাভিটি এত বেশি থাকে যে ভিতর থেকে কিছুই বের হতে পারে না, এমনকি আলোও না। আলোও বের হতে পারে না বলে এদেরকে দেখা যায় না, এজন্যই নামটা ব্ল্যাকহোল। মিল্কিওয়ের কেন্দ্রীয় এলাকায় যেহেতু অনেক বেশি তারা সেহেতু তারার লাশের সংখ্যাও বেশি, ঘনত্বও বেশি, যেমন গ্রামের চেয়ে শহরে গোরস্থান বেশি। এইসব লাশ মার্জ করতে করতে বড় হতে থাকে, এভাবেই এক সময় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে তৈরি হয় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল।
সক্রেটিস: কিন্তু কেন্দ্রেই কেন? সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল কি আর কোথাও থাকতে পারত না?
শশী: আইনস্টাইন দরকার নেই, অন্তত নিউটন বুঝলেই তুমি আর এই কথা বলতে পারতে না। যেকোনো একটা গ্র্যাভিটেশনাল সিস্টেমে যার ভর সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিকভাবে সে-ই সিস্টেমটার ভরকেন্দ্রের সবচেয়ে কাছে থাকবে, যেমন সিস বা টিটার-টটারে যে বাচ্চা যত ভারী তাকে ফালক্রামের তত কাছাকাছি বসতে হয়। সূর্য সবচেয়ে ভারী হওয়ায় যেহেতু সৌরজগতের প্রায় কেন্দ্রে, তেমনি আমাদের ব্ল্যাকহোল আমাদের গ্যালাক্সির প্রায় কেন্দ্রে। আর তার দুই পাশে একটা বারের মতো অঞ্চলে তারার সংখ্যা এতই বেশি যে আমাদের কাছে এত দূর থেকে পুরো বারটাকে একটা একক বস্তু মনে হচ্ছে। এই বারের দুই প্রান্ত থেকেই বের হয়েছে দুই প্রধান স্পাইরাল আর্ম: আমাদের এই দৃষ্টিকোণে উপর থেকে পার্সিয়াস আর্ম আর নিচ থেকে স্কুটাম-সেন্টরাস আর্ম। সূর্যকে তো আর এত দূর থেকে দেখা যাবে না, কিন্তু আমার এই ছবিতে দেখতে পারো সূর্যের গতিপথ। কেন্দ্রের চারদিকে এই কক্ষপথে সূর্য আমাদের গ্যালাক্সিকে প্রতি ২৫০ মিলিয়ন বছরে (১ গ্যালাক্টিক বছর) একবার আবর্তন করে।
হার্মিস: আবার উড়াল দিলে কিন্তু আমরা মিল্কিওয়ের এজ-অন ভিউটাও দেখতে পাব, মানে তার ডিস্কটা কত চিকন সেটাও বুঝতে পারব।
সক্রেটিস: হার্মিস থাকে শুধু উড়াল দেয়ার তালে।
[সবাই এক মুহূর্তে মিল্কিওয়ে থেকে ৫ লাখ লাইট ইয়ার দূরে ডিস্ক বরাবর এক জায়গায় চলে যায়।]
শশী: থিন ডিস্কটা ভালো দেখা যাচ্ছে, এর সাইজ মাত্র ১ হাজার লাইট ইয়ার। কেউ ড্রোনের মতো এই ডিস্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে মিল্কিওয়ের ছবি তোলার জন্য, কিন্তু সেক্ষেত্রেও লাখ লাখ বছর লাগবে। থিন ডিস্কের দুই পাশে আছে ১০ হাজার লাইট ইয়ার পুরুত্বের থিক ডিস্ক। ডিস্কের মধ্যে পপুলেশন-১ (নবীন) তারার দল প্রায় সার্কুলার পথে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে আবর্তন করে। কেন্দ্রে যেখানে আমরা আগে বার দেখেছিলাম সেখানেই এখন একটা বালজ দেখা যাচ্ছে, মানে মাঝখানের একটা স্ফীত অঞ্চল যেখানে তারার সংখ্যা ও ঘনত্ব অনেক বেশি। এই পুরো ডিস্ক ঘিরে আছে একটা গোলাকার স্টেলার হেলো, যেখানে পপুলেশন-২ (প্রবীণ) তারারা ঘুরাফেরা করে, অনেক এলিপ্টিকেল কক্ষপথে কখনো ডিস্ক ভেদ করে নিচে নেমে যায়, আবার উপরে উঠে। হেলোতে ভিজিবল ম্যাটারের চেয়ে ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব বেশি। তবে হেলোর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জিনিস হলো ঐ সব ছড়ানো ছিটানো গ্লবুলার ক্লাস্টার। একেকটা ক্লাস্টারে এক থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত তারা আছে, সবাই অনেক পুরানো।
সক্রেটিস: কত পুরান?
শশী: আমাদের গ্যালাক্সি যত পুরান, মানে প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর। তেরশ কোটি বছর আগে আমাদের গ্যালাক্সি সম্ভবত অনেক ইরেগুলার ছিল, সেখানে প্রথম যেসব তারার জন্ম হয়েছিল তাদের মধ্যে সাইজে সূর্যের চেয়ে অনেক ছোটরাই কেবল এখনো টিকে আছে, ডিস্কের উপরে বা নিচে, গ্লবুলার ক্লাস্টারে। ডিস্কে এই প্রবীণদের জায়গা নেই। ডিস্ক শুধু নবীন তারাদের জায়গা। নতুন প্রজন্ম কিভাবে পুরান প্রজন্মকে তাড়ায় তা এর চেয়ে ভালো আর কোথাও দেখা সম্ভব না।
সক্রেটিস: কিন্তু সেই ইরেগুলার অবস্থা থেকে প্রথমে ডিস্ক তার পর ডিস্কের মধ্যে স্পাইরাল আর্ম কিভাবে হলো?
শশী: কিভাবে হয়েছে তার ডিটেল প্রসেস আমরা এখনো জানি না। তবে স্টেলার যুগে গ্যাসের বিশাল ইরেগুলার মেঘ থেকে ফ্ল্যাট সোলার সিস্টেমের জন্ম যখন ব্যাখ্যা করা হবে তখন এই প্রক্রিয়া আরো পরিষ্কার হবে। কাজটা তখন করাই ভালো, কারণ স্পাইরাল গ্যালাক্সিরা আমাদের সৌরজগতের মতোই ফ্ল্যাট। আপাতত বলে রাখতে পারি, আমাদের গ্যালাক্সির থিন ডিস্ক গঠিত হয়েছে ৯ বিলিয়ন বছর আগে, আর সেই ডিস্কে স্পাইরাল আর্ম এসেছে মাত্র ৫.৫ বিলিয়ন বছর আগে, মানে আসলেই স্টেলার যুগে।
হার্মিস: তাহলে চলো এবার হোয়ার্লপুলের দিকে। যেতে যতে আমরা বিভিন্ন টাইপের গ্যালাক্সির কথা শুনি।
শশী: এডুইন হাবল প্রথম নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছিলেন আমাদের গ্যালাক্সি ছাড়াও আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে, এন্ড্রমিডা ‘নেবুলা’ নামে পরিচিত ফাজি জিনিসটা যে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরের আরেকটা গ্যালাক্সি তা প্রথম তিনি বুঝছিলেন ১৯২৪ সালে। আরো অনেক গ্যালাক্সি আবিষ্কারের পর তিনি টিউনিং ফর্কের মতো একটা বিন্যাসে তাদেরকে সাজান, এই ছবির মতো।
সক্রেটিস: এখানে তিনটা প্যানেল মনে হচ্ছে তিন যুগে এই বিভিন্ন টাইপের গ্যালাক্সি দেখতে কি রকম ছিল তা বুঝাতে চাচ্ছে। সবার বামের প্যানেলেটা বর্তমানের। অন্য দুটা ৪ ও ১১ বিলিয়ন বছর আগের। গ্যালাক্সি মনে হচ্ছে মূলত তিন ধরনের, এলিপ্টিকেল, লেন্টিকুলার, স্পাইরাল, তবে স্পাইরালের মধ্যে আবার বার্ড স্পাইরাল একটা আলাদা টাইপ।
শশী: এছাড়াও ‘ইরেগুলার’ একটা আলাদা টাইপ যা এখানে দেখানো হয়নি, যেহেতু সেটা কোনো শেইপের মধ্যে পড়ে না। দেখে তো বুঝতেই পারছ, এলিপ্টিকেল গ্যালাক্সি আবার ০ থেকে ৭ পর্যন্ত সাত টাইপের, ই০ সবচেয়ে গোল, ই৭ সবচেয়ে ওভাল। লেন্টিকুলার গ্যালাক্সি এস০ দিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে কারণ এরা এলিপ্টিকেল ও স্পাইরালের মাঝামাঝি, স্পাইরালের মতো এদের ডিস্ক আছে কিন্তু স্পাইরাল আর্ম নেই, আবার এলিপ্টিকেলের মতো এদের একটা বিশাল ওভাল বালজ আছে ডিস্কের চারদিকে। স্পাইরাল গ্যালাক্সি ‘এ’ থেকে ‘ডি’ পর্যন্ত চার টাইপের হতে পারে বালজ ও আর্মের ধরনের উপর ভিত্তি করে। এসএ গ্যালাক্সির বালজ সবচেয়ে বড়, আর্ম সবচেয়ে মসৃণ, আর এসডি গ্যালাক্সির বালজ সবচেয়ে ছোট, আর্ম সবচেয়ে বেশি ছাড়া-ছাড়া। নিচের বার্ড স্পাইরালের মধ্যেও একই শ্রেণিবিন্যাস করা যায়, পার্থক্য শুধু এই যে এদের বালজের সাথে বার আছে।
সক্রেটিস: আমার তো মনে হচ্ছে একটা গ্যালাক্সি প্রথমে এলিপ্টিকেল হিসেবে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে লেন্টিকুলার হয়ে এক সময় স্পাইরাল হয়।
শশী: হাবল নিজেও তাই মনে করেছিলেন। এই কারণে লালচে এলিপ্টিকেল গ্যালাক্সিদের তিনি আর্লি-টাইপ বলেছিলেন, আর নীলচে স্পাইরালদের বলেছিলেন লেইট-টাইপ। কিন্তু আসলে এই সব টাইপের গ্যালাক্সিই বোধহয় গত ১১ বিলিয়ন বছর ধরে সব সময়ই ছিল, শুধু যত অতীতে যাওয়া যায় প্রতি টাইপের গ্যালাক্সির স্ট্রাকচার তত অস্পষ্ট ও অগঠিত হতে থাকে। এলিপ্টিকেল গ্যালাক্সি এক সময় স্পাইরাল হয়ে যেতে পারে, কিন্তু উল্টাটাও হতে পারে।
সক্রেটিস: এই পরিবর্তন তাহলে হয় কেন?
শশী: প্রধানত এক গ্যালাক্সির সাথে আরেক গ্যালাক্সির মার্জিং বা ক্লাস্টার পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের ইন্টারেকশনের কারণে। বলতে বলতে আমরা হোয়ার্লপুলের কাছে চলে আসলাম। সচক্ষে দেখো তাহলে একটা মার্জার, যদিও দুই গ্যালাক্সি একসাথে পুরো মিশে যেতে কয়েক কোটি বছর লাগে। হোয়ার্লপুল এখন আমাদের আকাশে ১০ ডিগ্রি, মানে পৃথিবীর আকাশে সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ বড়। পিছনের গ্যালাক্সিটা আসলে ইরেগুলার, বা ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি। কিন্তু এই ইন্টারেকশনের কারণে বড় গ্যালাক্সির আকৃতিও কিছুটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। একটা বড় স্পাইরাল গ্যালাক্সি এই ধরনের ইন্টারেকশনের কারণে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও ইরেগুলার হয়ে যেতে পারে। এন্টেনা গ্যালাক্সিও একটা ভালো উদাহরণ। চলো এবার এই দুই গ্যালাক্সির কাছ থেকে ঘুরে আসি।
সক্রেটিস: এন্টেনা গ্যালাক্সির লেজ দুইটা এত বড় কেন, কি দিয়ে তৈরি? গ্যাস?
শশী: না, তারা। গ্যালাক্সি দুইটা একে অপরকে কেন্দ্র করে স্পাইরাল পথে ঘুরতে ঘুরতে একত্রিত হয়। এ সময় দুই গ্যালাক্সির তারারা আসলে ধ্বংস হয় না বা একে অপরের সাথে সংঘর্ষও করে না। কারণ গ্যালাক্সিতে তারাদের মধ্যে গড় দূরত্ব অনেক। মিলনের সময় পারস্পরিক মহাকর্ষের প্রভাবে এক গ্যালাক্সি আরেক গ্যালাক্সির তারা খসিয়ে গ্যালাক্সি থেকে বের করে দেয়। এই বের হয়ে যাওয়া তারাদের দিয়েই তৈরি হয়েছে দুই এন্টেনা গ্যালাক্সির দুই লেজ।
সক্রেটিস: মার্জিঙের কেন্দ্রটা এত উজ্জ্বল কেন, সাধারণ গ্যালাক্সির চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে।
শশী: এর কারণ দুই গ্যালাক্সির গ্যাসের সংঘর্ষ। গ্যালাক্সিতে শুধু তারাই থাকে না, সাথে থাকে অনেক ইন্টারস্টেলার গ্যাস। গ্যাসের সাইজ যেহেতু তারার চেয়ে অনেক বড় সেহেতু দুই গ্যালাক্সির গ্যাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তখন গ্যাসের ক্লাউডরা একে অপরকে গরম করে সংকুচিত ও উত্তপ্ত করে হঠাৎ নতুন অনেক তারার জন্ম দেয়। এই ঘটনার নাম স্টারবার্স্ট এবং তা যেসব গ্যালাক্সিতে ঘটে তাদেরকে বলে স্টারবার্স্ট গ্যালাক্সি।
সক্রেটিস: এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা রিং দেখা যাচ্ছে না?
শশী: হ্যাঁ, এর কারণও মার্জিং। এন্টেনা যুগলের ক্ষেত্রে দুইটা গ্যালাক্সি মুখোমুখি সংঘর্ষে যায়নি, কিন্তু এক্ষেত্রে একটা গ্যালাক্সি সোজা আরেকটার উপর আছড়ে পড়েছে। মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে মেসিয়ে ৯৫ নামে পরিচিত এই গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে একটা লঙ্গিচুডিনাল তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে। এই তরঙ্গ সংকোচন ও প্রসারণের পর্যায়ক্রমিক ধারার মাধ্যমে তৈরি হয়। তরঙ্গের সংকোচনের জায়গাতে গ্যাস ঘন হয়ে নতুন অনেক তারার জন্ম দেয়। এমন একটা সংকোচনের ফ্রন্টই দেখতে পাচ্ছ, সক্রেটিস।
সক্রেটিস: এমন মার্জিঙের সময় দুই গ্যালাক্সির দুই সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের কি হয়?
শশী: অবশ্যই দুই ব্ল্যাকহোলও এক সময় একত্রিত হয়ে যায়, কিন্তু অনেক সময় লাগে। দুই গ্যালাক্সি যতদিনে একত্রিত হয়ে একদম এক হয়ে যাবে, দুই ব্ল্যাকহোলও ততদিনে এক হতে পারে। তবে ব্ল্যাকহোলের ভাগ্য আরো ইন্টারেস্টিং। মার্জিঙের কারণে গ্যালাক্সি যেমন স্টারবার্স্ট হতে পারে তেমনি আবার হতে পারে এক্টিভ। যেসব গ্যালাক্সির কেন্দ্রের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল সক্রিয়ভাবে তার বিষুবাঞ্চলের এক্রিশন ডিস্ক থেকে তারা গ্যাস ইত্যাদি গিলতে থাকে আর দুই মেরু থেকে জেট নিঃসরণ করে তাদেরকেই এক্টিভ গ্যালাক্সি বা এক্টিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াস (এজিএন) বলে, কারণ কেবল নিউক্লিয়াসটাই সক্রিয়।
হার্মিস: সচক্ষে দেখার জন্য আমরা সরাসরি সেন্টরাস এ গ্যালাক্সির কাছে চলে যাই, চলো।
সক্রেটিস: আমি তো শুধু একটা বোরিং ডাস্টি ডিস্ক দেখছি, তাও কেমন এবড়োখেবড়ো।
শশী: তার কারণ, সক্রেটিস, কেন্দ্র থেকে বের হওয়া জেট শুধু রেডিও তরঙ্গে দেখা যায়, আর জেটের আশপাশের গরম গ্যাস দেখা যায় শুধু এক্সরে দিয়ে। আমরা যেহেতু শুধু ভিজিবল লাইট দেখছি সেহেতু এখানে ডিস্কের ডাস্ট ছাড়া কিছু দেখা যাবে না।
ইশ্তার: তাহলে, যাও, তোমাদের সবাইকে সব ফ্রিকোয়েন্সির আলো দেখার ক্ষমতা দিয়ে দিলাম। দেখো তিন আলোতে আপাতত।
সক্রেটিস: এর চেয়ে সুন্দর গ্যালাক্সি জীবনে দেখিনি। কোনো টেলিস্কোপের ছবিতে এত সুন্দর লাগা সম্ভব না। কিন্তু, ইশ্তার, রেডিও আর এক্সরের জন্য তুমি তো অন্য কোনো অদ্ভুত কালার বানাওনি, আমাদের পরিচিত ভিজিবল রং দিয়েই সব দেখাচ্ছ।
ইশ্তার: অন্য কোনো রং কল্পনার শক্তি আমার নেই। ভিজিবলের বাইরে কিছু কল্পনা করা আপাতত যেহেতু সম্ভব না, অন্য সব রং কেবল ভিজিবল লাইটের রং দিয়েই না হয় দেখো। ফলস কালার ছবিতেও ট্রু কালার ছবির চেয়ে বেশি মজা পাওয়া যায়, জানো তো।
সক্রেটিস: জানি না।
শশী: যাই হোক, আমি এই মডেলের মাধ্যমে এজিএনের ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করি। সব এজিএন আসলে প্রায় একই রকম, কিন্তু পৃথিবী থেকে মানুষ একেক কোণে দেখে বলে তাদের কাছে একেক রকম লাগে, একেক এঙ্গেল থেকে দেখা এজিএনের জন্য তারা একেক নাম বানিয়েছে। মেরু অর্থাৎ জেট বরাবর দেখলে ব্লেজার, বিষুব অর্থাৎ ডিস্ক বরাবর দেখলে সিফার্ট-২ বা ন্যারো-লাইন গ্যালাক্সি, আর এর মাঝামাঝি কোণ থেকে দেখলে কোয়েজার, সিফার্ট-১ বা ব্রড-লাইন গ্যালাক্সি। কাহিনি সব ক্ষেত্রে একই। কেন্দ্রে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল, তার চারদিকে সরু এক্রিশন ডিস্ক, যেখানের গ্যাস ও তারা ব্ল্যাকহোলে ঢুকতে থাকে, আর সবকিছু ঘিরে আছে ডোনাটের মতো একটা ডাস্টি টোরাস। এক্রিশন ডিস্কের কাছের গ্যাসের বেগ বেশি, দূরের গ্যাসের বেগ কম; এজন্য কাছ থেকে কেন ব্রড-লাইন পাওয়া যায় (লাইন মানেই বা কি) আর দূর থেকে কেন ন্যারো-লাইন সে নিয়ে পরে কথা হবে।
সক্রেটিস: মনে হচ্ছে এক্রিশন ডিস্কটা ব্ল্যাকহোলের খাবার টেবিল আর দুই মেরু বর্জ্য ত্যাগের জায়গা।
শশী: তা বলতে পারো। ডিস্কের গ্যাস তারা সব খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ব্ল্যাকহোল নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, এজিএন আর থাকে না। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোল নিষ্ক্রিয়। তবে মার্জার বা আশপাশের সাথে ইন্টারেকশনের কারণে কোনো গ্যালাক্সির ব্ল্যাকহোল আবার সক্রিয় হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোল পালাক্রমে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় হতে থাকে কোটি বছরের ব্যবধানে।
সক্রেটিস: তাহলে এজিএন তো বেশ ভয়ংকর জায়গা হবে থাকার জন্য। আমরা সেন্টরাস এ’র বেশি কাছে না যাই।
শশী: বিপদজনক কিন্তু শুধু এক্টিভ গ্যালাক্সিই না। দেখা গেছে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় যেকোনো গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলটাই ডেঞ্জারাস, কারণ সেখানে তারা অনেক বেশি। তারা বেশি হলে মরবেও বেশি, মরার সময় সুপারনোভা বিস্ফোরণও হবে বেশি। ফলে গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে কোনো একটা তারার জগৎ একটানা অনেক বছর ধরে নিরাপদে থাকতে পারে না। মানুষের মতো উন্নত প্রাণী জন্মাতে যত বছর লাগে তত বছর নিরাপদ সময় হয়ত সেখানে পাওয়া যায় না। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে গ্যালাক্সিতে এমন একটা অঞ্চলও হিসাব করা হয়েছে যেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটতে পারে, এই অঞ্চলের নাম গ্যালাক্টিক হ্যাবিটেবল জোন। মানুষ মিল্কিওয়ের নিরাপদ গ্রামাঞ্চলে থাকে, তাই বিপদ বেশ কম।
হার্মিস: চলো, আমরা আবার পৃথিবীতে ফেরত যাই, এবার নৌকায় সাংপো নদীতে ভ্রমণ হোক।
শশী: নৌকা আসলে খুব ভালো জায়গা আমি এখন যা বলতে চাই তা বুঝানোর জন্য। বিশ শতকের শুরুতেও আমরা জানতাম না যে মিল্কিওয়ের বাইরে আর কোনো গ্যালাক্সি আছে। সবাই ভাবত মিল্কিওয়েই মহাবিশ্ব। আঠার শতকে ফ্রান্সের শার্ল মেসিয়ে এমন অনেক নেবুলার লিস্ট করেছিলেন যারা আসলে গ্যালাক্সি, কিন্তু তখন মনে করা হতো এরা আমাদের গ্যালাক্সির ভিতরের গ্যাস। এর উল্টা কথা যে একেবারেই বলত না তা না। যেমন, জার্মানির দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তখন জানা নেবুলাগুলিকে আলাদা ‘আইল্যান্ড ইউনিভার্স’ বলেছিলেন। কিন্তু দূরত্ব না জানলে এসব প্রমাণ করা সম্ভব না।
সক্রেটিস: দূরত্ব তো শুধু না, আমাদের গ্যালাক্সির সাইজও তো জানতে হবে।
শশী: হ্যাঁ, আমাদের গ্যালাক্সির সাইজ আর একটা নেবুলার দূরত্ব যদি জানি, তারপর যদি দেখা যায় নেবুলার দূরত্ব আমাদের গ্যালাক্সির সাইজের চেয়ে অনেক বেশি, তাহলে ধরে নিতে হবে নেবুলাটা আসলে স্বাধীন গ্যালাক্সি। সাইজের একটা ধারণা উনিশ শতকেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দূরত্ব মাপার একটা উপায় প্রথম ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন হেনরিয়েটা সোয়ান লিভিট, ১৯১২ সালে। তিনি সিফিড ভ্যারিয়েবল নামে পরিচিত কিছু ভ্যারিয়েবল স্টারের উজ্জ্বলতা পরিবর্তনের পিরিয়ডের সাথে তাদের আসল উজ্জ্বলতার একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করেন।
সক্রেটিস: ‘আসল’ উজ্জ্বলতা মানে?
শশী: একটা তারার আসল উজ্জ্বলতা আমরা কখনো জানি না। যেমন এই রাতের বেলায় নদীর এই তীরে অনেক বাড়ির ভিতরের আলো দেখা যাচ্ছে। সব বাড়িতে হয়ত একই পাওয়ারের বাল্ব ইউজ করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের থেকে যে বাড়ি যত দূরে তার আলো তত কম মনে হচ্ছে, মানে আমরা যা দেখছি তা হলো ‘আপাত’ উজ্জ্বলতা। এখন কোনোভাবে যদি আমি একটা বাড়ির বাল্ব্বের ‘আসল’ উজ্জ্বলতা জানি তাহলে আসলের সাথে আপাত মিলিয়ে হিসাব করতে পারব বাড়িটা কত দূরে। একটা বিশ ওয়াটের বাল্ব আমার চোখে যদি দশ ওয়াট মনে হয় তাহলে বাড়িটা যত দূরে, পাঁচ ওয়াট মনে হলে বাড়িটা তার থেকে আরো দূরে হবে। কিন্তু আসল উজ্জ্বলতা জানার জন্য তো সেই বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া উপায় নাই। লিভিট এই জিজ্ঞাসা করার বিকল্পই খুঁজে পেয়েছিলেন, তার বাড়ি ছিল সিফিড ভ্যারিয়েবল তারা। আমি যদি অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে থাকা একটা সিফিডের আসল উজ্জ্বলতা জেনে তার দূরত্ব বের করে ফেলতে পারি তাহলেই সেই গ্যালাক্সির দূরত্ব জানা হয়ে যাবে।
সক্রেটিস: তো লিভিট প্রথম কোন গ্যালাক্সির দূরত্ব বের করেছিলেন।
শশী: লিভিট উপায়টা বের করেছেন, কিন্তু তা ভালোভাবে প্রথম কাজে লাগাতে পেরেছিলেন এডুইন হাবল ১৯২০-এর দশকে। হাবল প্রায় ত্রিশটা গ্যালাক্সির দূরত্ব আর বেগ মাপতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেন: দূরের সব গ্যালাক্সি আমাদের থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে এবং যে গ্যালাক্সি যত দূরে তার দূরে সরার বেগও তত বেশি। দূরত্বের সাথে বেগের এই সম্পর্ক এই ছবির ইনসেটে দেখানো হয়েছে।
সক্রেটিস: বেগ কিভাবে মেপেছিলেন?
শশী: সেটা সহজ। ডপলার ইফেক্টের মাধ্যমে। ব্যাখ্যা করি। ঐ দেখো একটা নৌকা আমাদের দিকে আসছে দূর থেকে আর নৌকায় কে জানি ডুংচেন বাজাচ্ছে। নৌকাটা আমাদের দিকে আসার সময় ডুংচেনের শব্দে কোনো পরিবর্তন টের পাচ্ছ?
সক্রেটিস: যত কাছে আসছে, শব্দ তত তীক্ষ্ণ হচ্ছে।
শশী: মানে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ছে, ওয়েভলেন্থ কমছে। এখন নৌকাটা আমাদের ছাড়িয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। এখন শুনে দেখো ডুংচেনের শব্দের তীক্ষ্ণতা কমছে, মানে ফ্রিকোয়েন্সি কমছে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ছে। যে ছবিটা দেখালাম সেখানে ইউনিভার্সের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটাই বুঝানো হয়েছে। মহাবিশ্ব যেহেতু প্রসারিত হচ্ছে সেহেতু সব গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, একটা বেলুনের উপরে আঁকা সব বিন্দু বেলুন ফুলালে যেভাবে সরে যায়। আসলে গ্যালাক্সিরা সরছে না, স্থান (বেলুন) প্রসারিত হওয়ায় তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। কোনো গ্যালাক্সি যদি আমাদের থেকে দূরে সরে যায় তাহলে ঐ চলে যাওয়া নৌকার মতোই তার আলোর ফ্রিকোয়েন্সি আমাদের কাছে কম মনে হবে। নীলের চেয়ে লালের ফ্রিকোয়েন্সি যেহেতু কম সেহেতু ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তনের এই ব্যাপারটাকে রেডশিফট বলে। আমরা দেখি সব গ্যালাক্সির আলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লাল, লালের দিকে সরে যাচ্ছে। কোন গ্যালাক্সির আলো লালের দিকে কতটুকু সরছে তা নির্ভর করবে তার পিছুহটার বেগের উপর। ঠিক যেমন ঐ নৌকাটা যদি আরো দ্রুত আমাদের থেকে সরে যেতো, তবে ডুংচেনের শব্দের তীক্ষ্ণতা আরো কম মনে হতো। গ্যালাক্সির আলো আসলে কেমন রঙের হওয়া উচিত তা আমরা জানি। এর সাথে গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর তুলনা করে রেডশিফটের পরিমাণ জানা যায় এবং সেখান থেকেই বেগ মাপা যায়। এভাবেই হাবল তার বিখ্যাত ডায়াগ্রাম বানিয়েছিলেন, যার এক্স এক্সিসে গ্যালাক্সির পিছুহটার বেগ, ওয়াই এক্সিসে দূরত্ব, এবং রিলেশনটা একটা সরলরেখা অনুসরণ করে।
সক্রেটিস: কিন্তু এর মানে কি?
শশী: কি মনে হয়?
সক্রেটিস: মনে হয় সব গ্যালাক্সি আগে আরো কাছাকাছি ছিল, যেমন বেলুন আগে আরো ছোট ছিল।
শশী: ঠিক এই ব্যাপারটাই আইনস্টাইন বিশের দশকের শুরুতে বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন মহাবিশ্ব স্থির। কিন্তু দেখা গেল আসলে সব গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে ছুটে যাচ্ছে, মানে সবাই আগে আরো ছোট জায়গায় ছিল। এবং পিছাতে পিছাতে যদি অনেক অতীতে যাই তাহলে নিশ্চয়ই দেখব সব গ্যালাক্সির সব এনার্জি-ম্যাটার শুরুতে একটা একক বিন্দুতে ছিল, যেখান থেকেই হয়েছে বিগ ব্যাং। এভাবেই বিশ শতকে গ্যালাক্সি গবেষণার মাধ্যমে আমরা জেনেছি আমাদের কসমিক ইতিহাস।
সক্রেটিস: গ্যালাক্সিদের বেগ থেকেই নাকি মহাবিশ্বের বয়স বের করে ফেলা যায়?
শশী: হ্যাঁ, হাবল ধ্রুবক থেকে। আমাদের থেকে ১ মিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরের গ্যালাক্সিদের পিছুহটার বেগই হাবল ধ্রুবক, বর্তমানের সবচেয়ে ভালো টেলিস্কোপ দিয়ে এর যে মান পাওয়া গেছে তা হলো ২১ কিমি/সেকেন্ড/মেগালাইটিয়ার, মানে প্রতি ১ মেগা লাইট ইয়ার দূরত্বে গ্যালাক্সিদের বেগ ২১ কিমি/সেকেন্ড করে বেড়ে যায়। দুই মেগালাইটিয়ার দূরের গ্যালাক্সিদের বেগ ৪২ কিমি/সেকেন্ড, তিন মিলিয়ন লাইটিয়ার দূরে ৬৩ কিমি/সেকেন্ড। হাবল ধ্রুবকের ইনভার্সই হলো ইউনিভার্সের বয়স। ১ কে ২১ কিমি/সেকেন্ড/মেগালাইটিয়ার দিয়ে ভাগ করলেই (মনে রেখে যে ১ মেগালাইটিয়ার = ৯.৫ × ১০১৪ কিমি) পাওয়া যায় আনুমানিক ১৪ বিলিয়ন বছর, আমাদের ইউনিভার্সের বয়স।